বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
জ্ঞা ন বি জ্ঞা নে বরণীয় যারা

মায়ের প্রেরণায় পৃথিবী আলোকিত করেন আলভা এডিসন

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

মমতাময়ী মায়ের অনুপ্রেরণায় বৈদু্যতিক বাতি আবিষ্কার করে গোটা পৃথিবী আলোকিত করেছিলেন টমাস আলভা এডিসন। সফল বিজ্ঞানী হিসেবে গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরাসহ আরও অনেক যন্ত্র আবিষ্কার করেন তিনি। আধুনিক শিল্পায়নের যুগান্তকারী উন্নতি ঘটেছিল তার হাত ধরেই। টমাস এডিসন ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রম্নয়ারি আমেরিকার ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের মিলানে জন্মগ্রহণ করেন।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলভা এডিসন মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই জন্ম দিয়েছেন মজার সব কান্ড-কারখানার।

লেখাপড়ায় অনেকটাই দুর্বল ছিলেন এডিসন। স্কুলে পড়াকালে পরীক্ষায় একবার ফলাফল খারাপ করায় চিঠি দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। চিঠি পেয়ে মা কী জানি ভাবছিলেন সজল দৃষ্টিতে! তারপর এডিসনের সামনেই উচ্চৈঃস্বরে পড়তে লাগলেন চিঠিটা। 'আপনার পুত্র খুব মেধাবী, এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন'। চিঠির কথা শুনে এডিসনের চোখ ভরে উঠেছিল অশ্রম্নতে।

তখন থেকে মায়ের কাছেই শিক্ষা নেওয়া শুরু করলেন তিনি। এরপর অতিবাহিত হয়েছে অনেক বছর। টমাস আলভা এডিসন হয়ে ওঠেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, শিল্পপতি এবং মার্কেটিং জগতে সফল উদ্যোক্তা। তখন আর জীবিত ছিলেন না মা। নিজের চোখে দেখে যেতে পারেননি সন্তানের বিশ্বজোড়া সাফল্যগাথা।

একদিন কি এক কাজে পুরনো কাগজ নাড়াচাড়া করছিলেন এডিসন। ভাঁজ করা এক কাগজের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল তার। বহু বছর আগে স্কুল থেকে পাঠানো সেই চিঠি। সেটা পড়তে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল অদ্ভুত এক অনুভূতির! অজানা এক ব্যথায় তার বুকে ভেসে গিয়েছিল চোখের জলে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল- 'আপনার সন্তান স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন, সে এই স্কুলের উপযুক্ত নয়, আমরা কোনোভাবেই তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না'।

আধুনিক বৈদু্যতিক বাতি, সাউন্ড রেকর্ডিং, ভিডিওগ্রাফির মতো আবিষ্কারসহ মোট ১০৯৩টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে তার নামে। পাশাপাশি টমাস আলভা এডিসন ছিলেন ইতিহাসের সেরা একজন সফল উদ্যোক্তা। তার রেখে যাওয়া সম্পদের আজকের মূল্য ১৭১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি! আজকের ইলন মাস্ক বা স্টিভ জবসের মতো টেক জিনিয়াসরা তাকে একবাক্যে গুরু মানেন। ইলন মাস্ক তো বেশ কয়েকবারই বলেছেন যে তার প্রধান অনুপ্রেরণাই হলেন 'আমেরিকা'স গ্রেটেস্ট ইনভেন্টর' টমাস এডিসন। বর্তমান যুগের প্রযুক্তির শুরু মূলত তার হাত দিয়েই।

যে লোকটি বৈদু্যতিক বাল্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে ১০ হাজার বার ব্যর্থ হয়েও থেমে না গিয়ে চেষ্টা করে গেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসকেও বদলে দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ল্যাবরেটরি 'উইজার্ড অব মিলানো পার্ক' তার হাতে গড়া। আধুনিক আমেরিকার উন্নত অর্থনীতি আর প্রযুক্তির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা লোকদের অন্যতম তিনি। ইতিহাসের সেরা আবিষ্কারক হিসেবে তিনি সারা বিশ্বে সম্মানিত। ১৯৩১ সালের ১৮ অক্টোবর এই অসাধারণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও সফল উদ্যোক্তার মৃতু্য হয়।

রাজনৈতিক কারণে কানাডা থেকে বিতাড়িত স্যামুয়েল এডিসন এবং স্কুল শিক্ষিকা ন্যান্সি এডিসনের ৭ ছেলেমেয়ের মধ্যে টমাস ছিলেন সবার ছোট। ছোটবেলায় লালজ্বরে আক্রান্ত হয়ে টমাসের দুই কানে ইনফেকশন হয় এবং বড় হয়েও তিনি কানে প্রায় শুনতেনই না।

১২ বছর বয়সে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রেললাইনে পত্রিকা বিক্রি করতে দেওয়ার জন্য বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেলেন টমাস। অল্প দিনের মধ্যেই নিজের একটি ছোট নিউজপেপার প্রকাশ করে ফেলেন, যার নাম ছিল, 'দি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক হেরাল্ড'। পত্রিকাটি যাত্রীদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই পত্রিকার মাধ্যমেই টমাস এডিসন একজন বিশাল উদ্যোক্তা হওয়ার পথে হাঁটা শুরু করেন। রেলস্টেশনের বগিতে মাঝেমধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে পরীক্ষা করতেন। এরকমই এক পরীক্ষার সময়ে একটি ব্যাগেজ বগিতে আগুন ধরে যায়। ট্র্রেনের কন্ডাক্টর দৌড়ে এসে টমাসের কান্ড দেখে তার গালে চড় মেরে বসে, এবং সেই ট্র্রেনে টমাসের ওঠা নিষেধ করে দেয়। এরপর থেকে টমাসকে ট্র্রেনে উঠে পত্রিকা বিক্রি করার বদলে পস্ন্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পত্রিকা বেচতে হতো।

এডিসন যখন রেলস্টেশনে কাজ করতেন, তখন একবার একটি ৩ বছরের বাচ্চাকে ট্র্রেনের নিচে পড়া থেকে বাঁচান। বাচ্চাটির বাবা ছিলেন একজন ট্রেলিগ্রাফ অপারেটর এবং তিনি টমাসকে প্রস্তার দেন যে তিনি তাকে টেলিগ্রাফ মেশিন অপারেট করা শেখাতে চান। টমাস ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি করার মতো দক্ষ হয়ে ওঠেন।

১৮৬৮ সালে টমাস বাড়ি ফিরে দেখতে পেলেন তার প্রাণপ্রিয় মা ন্যান্সি এডিসন রীতিমতো মানসিক রোগী হয়ে গেছেন। তার বাবাকেও কাজ থেকে অবসর দেওয়া হয়েছে। টমাস বুঝতে পারলেন, এ অবস্থা তাকেই সামাল দিতে হবে। এক বন্ধুর পরামর্শে টমাস এডিসন বোস্টনে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে বিখ্যাত 'ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন কোম্পানি'-তে কাজ নেন। সেই সময়ে বোস্টন ছিল আমেরিকার বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চার কেন্দ্র, টমাস আলভা এডিসনের জীবন কাহিনী এখানে সবচেয়ে বড় মোড়টি নেয়। তিনি ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) রেকর্ডার তৈরি করেন। পরে টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি আবিষ্কারক হয়ে যাবেন বলে ঠিক করেন। ১৮৭০ সালে আমেরিকার নিউ জার্সিতে তিনি প্রথম তার নিজের ল্যাব স্থাপন করেন।

১৮৭৬ সালে টমাস তার কার্যক্রম নিউজার্সির মেনলো পার্ক নামক জায়গায় স্থানান্তর করেন। সেখানে তিনি উন্নত ল্যাবরেটরি ও মেশিন ওয়ার্কশপসহ একটি ইনডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ফ্যাসিলিটি তৈরি করেন। ফোনোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করে তিনি প্রথমবারের মতো সারা বিশ্বে বিখ্যাত হন।

১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে তিনি তার ইলেকট্রিক কোম্পানি গড়ার কাজ শুরু করেন। তার স্বপ্ন ছিল পৃথিবীর সব শহরে তিনি বিদু্যৎ ও আলো পৌঁছে দেবেন। সেই বছর তিনি 'এডিসন ইলু্যমিনেটিং কোম্পানি' প্রতিষ্ঠা করেন। পরে যেটি 'জেনারেল ইলেকট্রিক করপোরেশন' নামে পরিচিতি পায়। এটি এখনো পৃথিবীর সেরা ইলেকট্রিক কোম্পানিগুলোর একটি।

১৮৮১ সালে টমাসের কোম্পানি বেশ কয়েকটি শহরে পাওয়ার প্যান্ট স্থাপন করা শুরু করেন। ১৮৮২ সালে তার কোম্পানি ম্যানহাটনের ৫৯টি বাড়িতে তাদের বিদু্যৎ ও আলোর সেবা দেওয়া শুরু করে। ১৮৯৬ সালের ২৩ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক শহরের 'কোস্টার অ্যান্ড বিয়াল'স মিউজিক হল'-এ, ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এডিসন চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকান সরকার তাকে 'ন্যাভাল কনসালটিং বোর্ড'-এর প্রধান হতে অনুরোধ করে। এই বোর্ডটি সেনাবাহিনী ও নৌ বাহিনীর অস্ত্র পরীক্ষা ও তার উন্নয়ন করত। দেশপ্রেমের জায়গা থেকে তিনি কাজটি করতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু নীতিগত জায়গা থেকে হত্যা ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে থাকার কারণে, মিসাইল ডেটেক্টর, অস্ত্রের লোকেশন বের করার টেকনিক- ইত্যাদি প্রজেক্টে কাজ করলেও কোনো অস্ত্র বানানোর প্রজেক্টে তিনি কাজ করেননি। তার সঙ্গে সরকারের চুক্তির শর্তই ছিল, তিনি শুধু ডিফেনসিভ ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে কাজ করবেন। পরে তিনি বলেছিলেন, 'আমি গর্বিত যে আমি কখনোই এমন কিছু আবিষ্কার করিনি, যা দিয়ে খুন করা যায়'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে