যানজটমুক্ত ঢাকা গড়তে গণপরিবহনের বিকল্প নেই

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অল্প জায়গায় বেশি যাত্রী পরিবহন করা যায় সেই ধরনের বাহনকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর জোর দেয়া উচিত। সেক্ষেত্রে বাসের সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। ঢাকায় বতর্মানে প্রাইভেট কারের ব্যবহার অত্যধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট কারে চলাচলে নিরুৎসাহিত করতে পাবলিক বাস, হেঁটে ও সাইকেলে চলাচলের সুযোগসুবিধা থাকা প্রয়োজন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি পরিহার করে ভালো মানের গাড়ি নামানো উচিত যেন সকল পযাের্য়র মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতে উৎসাহিত হয়।

প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
আমদের প্রাণের শহর ঢাকা বসবাসের অযোগ্য ২০১৮ সালে এমনই এক ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। বসবাসের অযোগ্য হওয়ার অনেক কারণ এর মধ্যে ‘দূষণ’ এবং ‘যানজট’ অন্যতম। দূষণ ও যানজট আন্তঃসম্পকির্ত। সড়কে দীঘর্ যানজট বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ঢাকা মেগাসিটিতে অন্তভুর্ক্ত হলেও ঢাকার মতো এত যানজট অন্যকোনো মেগাসিটিতে নেই। জনবহুল এই শহরে সকাল বেলায় এখন আর পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে না, পাখির ডাকের যায়গায় অবস্থা নিয়েছে গাড়ির হনের্র বিকট শব্দ। একটা সময় ঢাকা মসজিদের শহর নামে পরিচিত থাকলেও এখন সুধিজনরা ঢাকাকে গাড়ি আর যানজটের শহর বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান “নামবিও” কতৃর্ক প্রকাশিত “ওয়াল্ডর্ ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৮” এর তথ্য অনুযায়ী যানজট দিক দিয়ে বাংলাদেশ ২য় স্থানে রয়েছে। মাত্র ৩ বছর আগেও বাংলাদেশ ৩য় স্থানে ছিল। যানজটের মূল কারণ হিসাবে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে। “নামবিও” এর প্রতিবেদন হতে আরও জানা যায় যে, বিশ্বের সবচেয়ে কম যানজট-পূণর্ শহরের তালিকায় ১ম স্থানে রয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। এরপর অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সুইডেন (গোথেনবাগর্), সুইজারল্যান্ড (বাসেল), রোমানিয়ার দুটি শহর ব্রাসোভ ও তিমিসোয়ারা। আগামী ২০১৯ সালের মধ্যে পযার্য়ক্রমে বিশ্বের আরও ১৩টি শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই মধ্যে অন্তভুর্ক্ত কয়েকটি দেশ হল নরওয়ে, জামার্ন, ডেনমাকর্, স্পেন, বেলজিয়াম। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে গণপরিবহন হতে পারতো নাগরিকদের চলাচলের জন্য আদশর্ বাহন, সেখান এখন ব্যক্তিগত গাড়ির অবস্থান। মানুষ দিন দিন ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এর মূল কারণে রয়েছে গণপরিবহনের নানা সীমাবদ্ধতা। প্রথমত গণপরিবহনের অপ্রতুলতা, পরিস্থিতি এমন যে মূল লোকসমাগমের স্থান হতে কোনো রুটে পরিবহন সংখ্যা বেশি আবার কোনো রুটে তুলনামূলক কম কম। যেমন : ফামের্গট থেকে মিরপুরের গাড়ি অন্যান্য রুটের থেকে সংখ্যায় বেশি। একই সঙ্গে টিকিট ব্যবস্থা না থাকা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নারীদের অনিরাপত্তা, পরিবহনে আরামদায়কতার অভাব ইত্যাদি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া ও সামাজিক অধিপত্য দেখানোর জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে থাকে। ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই)Ñ কতৃর্ক প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরের ৬ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে রাস্তার ৭৬ ভাগ দখল করে আছে। ৬ থেকে ৮ ভাগ রাস্তা গণ-পরিবহনের দখলে আর রাস্তার বাকি অংশ পাকির্ং ও অবৈধ দখলে রয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট হচ্ছে নানান সমস্যাÑ ব্যক্তিগত গাড়ির সাথে সাথে গণপরিবহনে নানাভাবে তুলনা করলে দেখা যায় ব্যক্তিগত গাড়ি কম কাযের্পাযীতায় বেশি রাস্তা দখল করে। স্টামফোডর্ ইউনিভাসিির্ট বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ সরেজমিনে একটি জরিপ করে, এতে দেখা যায় ১টি ব্যক্তিগত গাড়িতে রাস্তায় যে পরিমাণ জায়গা দখল করে সমপরিমাণ জায়গায় একটি জায়গায় একটি হিউম্যান হলার দখল করে, ব্যক্তিগত গাড়িতে সাবোর্চ্চ ৫ জন ব্যক্তি আরোহন করতে পারে পক্ষান্তরে হিউম্যান হলারে ১৫ জন ব্যক্তি আরোহন করতে পারে। অপরদিকে ৩টি ব্যক্তিগত গাড়ি ১৫ জন ব্যক্তি নিয়ে যে স্থান দখল করে সেখানে ৩৬ জন থেকে ৪০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতার একটি গণপরিবহন স্থান নিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আরও ভিন্নতা দেখা যায়, বিত্তশালী একটি পরিবারের কমপক্ষে দুই বা ততধিক গাড়ি থাকে, ফলে মাত্র ২ থেকে ৪ জন লোকের জন্য যদি গড়ে ২টি গাড়ি রাস্তায় চলাচল করে ঐ পরিমাণ জায়গায় ৬টি বাইসাইকেল চলাচল করতে পারবে। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে জৈব জ্বালানির চাহিদা, বাড়ছে বায়ুদূষণ। বুয়েটের দুঘর্টনা রিসাচর্ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আথির্ক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ নামক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা অনুযায়ী দীঘর্ যানজটে বসে থেকে প্রতিদিন মানুষের ৫০ লাখ কমর্ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, বছরে এর আথির্ক মূল্য ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া যানজটে গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকলে সাধারণ ধেঁায়ার পাশাপাশি ক্ষতিকর টহনঁৎহবফ ঐুফৎড়পধৎনড়হ নিগর্ত হয়, উপরন্তু জ্বালানি তেল বা গ্যাসের অপচয় হয়। “নামবিও” গবেষণা সূচক অনুযায়ী কাবর্ন নিঃসরণে বাংলাদেশ এর অবস্থান ৩২ তম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অল্প জায়গায় বেশি যাত্রী পরিবহন করা যায় সেই ধরনের বাহনকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর জোর দেয়া উচিত। সেক্ষেত্রে বাসের সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। ঢাকায় বতর্মানে প্রাইভেট কারের ব্যবহার অত্যধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট কারে চলাচলে নিরুৎসাহিত করতে পাবলিক বাস, হেঁটে ও সাইকেলে চলাচলের সুযোগসুবিধা থাকা প্রয়োজন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি পরিহার করে ভালো মানের গাড়ি নামানো উচিত যেন সকল পযাের্য়র মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতে উৎসাহিত হয়। এ সকল সুবিধা না থাকায় ঢাকায় অনেকেই বাধ্য হয়েই প্রাইভেট কার ব্যবহার করছেন। উন্নত বাস সাভির্স চালুর মাধ্যমে প্রাইভেট কারের ওপর নিভর্রশীলতা কমিয়ে আনা সম্ভব। একদিন বেজোড় সংখ্যা এবং অন্যদিন জোড় সংখ্যার লাইসেন্স অনুযায়ী প্রাইভেট গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়। সেক্ষেত্রে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। মোটকথা যানজট হ্রাসে অতিসত্বর প্রাইভেট কার ব্যবহারে নিরুৎসাহী করতে বাসের যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোডর্ ইউনিভাসিির্ট বাংলাদেশ শধসৎঁষথংঁন@যড়ঃসধরষ.পড়স