শিখন হবে অভিজ্ঞতামূলক

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আরিফ আনজুম সহকারী শিক্ষক (বাংলা) আমতলী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় শিবগঞ্জ, বগুড়া।
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। এ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অন্যরকম এক শিক্ষা পদ্ধতির সূচনা করেছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে সারা বছর ধরে। এসএসসিতে থাকবে না কোনো বিভাগ, পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির লেখাপড়ায়। স্বাধীনতার পর থেকে একাধিকবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থাকে কখনোই মুখস্থ বিদ্যা আর পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন থেকে বের করা আনা সম্ভব হয়নি। আমাদের চিরাচরিত পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যার কারণে শিক্ষা জীবনের বেশির ভাগ জ্ঞান কর্মজীবনে তেমন কাজে আসে না। এমন পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্প-বিপস্নব আর পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির বাস্তবতা সামনে রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা বদলে ফেলা হয়েছে। প্রবর্তন করা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা পদ্ধতি। এর নামকরণ হয়েছে 'অভিজ্ঞতামূলক শিখন পদ্ধতি'। তবে নতুন এই পদ্ধতি জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডক্টর এম তারিক আহসান। তিনি বলেন, 'নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছে- ক্লাসরুমে শেখা ও শেখানো। পরীক্ষার বদলে সারা বছর ধরে নিরীক্ষা ও ব্যতিক্রমী পাঠ্যবই দ্বারা শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন। পহেলা জানুয়ারি থেকে তিনটি শ্রেণির শিশুদের হাতে যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়েছে তা মুখস্থ বা কনটেন্ট (পাঠ) নির্ভর নয়। প্রত্যেকটি বই একেকটি রিসোর্স বুক। এতে পাঠের তথ্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে সংগ্রহ করবে তা উলেস্নখ আছে। শেখার জন্য শিশুকে শিক্ষকের কাছে বা নোট-গাইডের ওপর নির্ভর করতে হবে না। এর পরিবর্তে তারা নিজের সহপাঠী, পরিবার ও সমাজ থেকে শিখবে। শিক্ষক শুধু এখানে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।' নতুন এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী কোনো কিছু না বুঝে পাস করার জন্য তোতা পাখির মতো মুখস্থ করবে না। যা জানবে, তা মুখস্থ করে না বরং প্রয়োগ করে বুঝবে। এর ফলে তার দক্ষতা বাড়বে। দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। এতে তার সার্বিক বিকাশ ঘটবে। এক কথায়, নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা পদ্ধতি সামাজিক, মানসিক, একাডেমিক বিকাশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এটি একজন শিক্ষার্থীকে কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। এ ছাড়া সৃষ্টিশীল মানুষ করবে, যাতে তারা আবিষ্কার বা সৃষ্টি করার মতো মানুষ হিসেবে বিকশিত হয়। সব মিলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনার বিকাশ ঘটবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের অভিমতে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতিতে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রথাগত পরীক্ষা থাকছে না। সারা বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে শিখন কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা হবে। কোনো সামষ্টিক বা অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না। বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষা হয় নবম-দশম শ্রেণিতে দুই বছরে পাঠদানের ওপর। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে শুধু দশম শ্রেণির লেখাপড়ার ওপর এসএসসি পরীক্ষা হবে। নবম শ্রেণিতে স্কুলেই মূল্যায়ন করা হবে। অন্যদিকে এইচএসসি পরীক্ষা বর্তমানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির লেখাপড়ার ওপর করা হয়ে থাকে। কিন্তু নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী একাদশ ও দ্বাদশে দুইবার পরীক্ষা হবে। দুটির ফল মিলিয়ে এইচএসসির ফল দেওয়া হবে। বর্তমানে এই পদ্ধতি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও এইচএসসি এবং ইংলিশ মিডিয়ামে চালু আছে। এই মূল্যায়নের নাম দেওয়া হয়েছে 'শিখনকালীন মূল্যায়ন'। এ ছাড়া পাঠদানের একটি অংশ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে 'সামষ্টিক মূল্যায়ন'র প্রস্তাব আছে। তবে কোচিং আর নোট-গাইড ব্যবসা দূর করতে সামষ্টিক পরীক্ষা বাতিলের চিন্তাও আছে। ফলে কাগজ-কলমনির্ভর পরীক্ষা থাকবে না। অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে-কলমে কাজ ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না। শিক্ষকরাই তাদের দেওয়া গাইড থেকে শেখাবেন। তবে এবার এই স্তরে আগের মতোই থাকছে। তাদের একটি বই ও ওয়ার্ক বুক দেওয়া হয়েছে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনটি করে বই থাকবে। নতুন শিক্ষাক্রমে চতুর্থ ও ৫ম শ্রেণিতে ৮টি বিষয় থাকছে। কিন্তু পাঠ্যবই দেওয়া হবে আগের মতোই ৬টি। এর মধ্যে পাঁচটি বিষয় হচ্ছে- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান। বাকি তিনটি হলো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্পকলা। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন ১০টি বিষয় থাকবে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। নবম-দশম শ্রেণিতেও ১০টি বিষয় থাকবে। প্রস্তাব ছিল এই স্তরে ৫০ শতাংশ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন, বাকি ৫০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। এইচএসসিতেও দুই ভাবে মূল্যায়নের প্রস্তাব ছিল। এতে একাদশ ও দ্বাদশে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ, আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসির বিষয়ে প্রস্তাব এখনো চূড়ান্ত নয় বলে মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জানা গেছে। ৫ম ও অষ্টম শ্রেণিতে কোনো শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থাকবে না। প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হবে দশম শ্রেণিতে। তাও শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুইটি পাবলিক পরীক্ষার সমন্বয়ে এইচএসসি পরীক্ষার ফল তৈরি করা হবে। এসএসসি স্তরে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে এখনকার মতো বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের মধ্যে কোনো বিভাগ থাকছে না। শিক্ষার্থীরা নবম-দশম শ্রেণিতে পড়বে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সিলেবাসের ১০টি বিষয়। বিভাগ নির্বাচন শুরু হবে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি থেকে। এইচএসসিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে। এই পদ্ধতি চালু হতে ৫ বছর বা ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। পদ্ধতি পুরোপুরি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নেবে বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতি। এর ফলে কোচিং আর গাইড ব্যবসাও বিদায় নেবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন এই শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হবে। আগামী বছর চালু হবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালু হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের প্রস্তাবে দেখা যায়, বর্তমানে পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীকে নম্বর বা গ্রেড দেওয়া হয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে এটি থাকবে না। এর পরিবর্তে তিন স্তরে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা মূল্যায়নের প্রাথমিক স্তরে থাকবে তাদের প্রাথমিক স্তর, পরের স্তর থাকবে তারা মধ্যম স্তর এবং সবচেয়ে ভালো করা শিক্ষার্থীদের পারদর্শী স্তর হিসেবে চিহ্নিত করে সনদ দেওয়া হবে। তবে এ বিষয়গুলো নিয়েও আরও চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানা গেছে। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় এখন শিক্ষাকে চ্যালেঞ্জের মুখে রাখা হয়েছে বলেও অভিহিত করা যায়।