বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
আইফেল টাওয়ার আইফেল টাওয়ার লোহার তৈরি আশ্চর্য এক কাঠামো। এটি ফ্রান্সের প্যারিস শহরে অবস্থিত। পৃথিবীর স্থাপনা নির্মাণের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী বিস্ময় এই টাওয়ার। ১৮৮৭ থেকে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। লৌহনির্মিত আইফেল টাওয়ারের অবস্থান প্যারিসের চ্যাম্প ডি মার্সে, শ্যেইন নদীর কাছে। ১৮৮৭ সালে ফ্রান্স সরকার ফরাসি বিপস্নবের স্মৃতি হিসেবে স্মরণীয় এক নিদর্শনে ধরে রাখার জন্যই এই প্রতীকী মিনারটি তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ কাজের জন্য বিখ্যাত সেতু প্রকৌশলী আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেলকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তিনি পেটা লোহার খোলা জাফরি (ঙঢ়বহ ষধঃঃরপব) দিয়ে ৩০০ মিটার (৯৮৪ ফুট) উঁচু এই নিখুঁত ও চমৎকার মিনারটি নির্মাণ করেন। তার নামানুসারেই মিনারটির নাম রাখা হয়েছিল 'আইফেল টাওয়ার'। গুস্তাভো আইফেল নির্মিত ৩২০ মিটার তথা ১০৫০ ফুট উচ্চতার এই টাওয়ারটি ছিল ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী ৪০ বছর ধরে পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার। গুস্তাভো আইফেল রেলের জন্য সেতুর নকশা প্রণয়ন করতেন এবং টাওয়ারটি নির্মাণে তিনি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন। ১৮,০৩৮ খন্ড লোহার তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ছোট-বড় কাঠামো জোড়া দিয়ে এই টাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল। এটির উপর দুইবার অ্যান্টেনা স্থাপনের ফলে আইফেল টাওয়ারের বর্তমান উচ্চতা ৩৩০ মিটার (১০৮৩ ফুট)। আইফেল টাওয়ার তৈরির কাজ ১৮৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে, ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চ শেষ হয়। এটি তৈরি করতে ৩০০ শ্রমিকের সময় লাগে সর্বমোট ২ বছর ২ মাস ৫ দিন। তারা ১৮,০৩৮ টুকরো রড আয়রন ও ২৫ লাখ নাটবোল্ট সংযোজন করে এই টাওয়ারটি নির্মাণ করেন। নির্মাণ শেষে এর ওজন দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার টন এবং উচ্চতা ৯৮৪.২৫ ফুট। এই টাওয়ারের নির্মাণকাজটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে এক বিপস্নবের সূচনা করেছিল। দু'একর জমিজুড়ে এর ভিত্তি। টাওয়ারটির চূড়া থেকে ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এক নজরে দেখে নেওয়া যায়। ১৯০৯ সালে এর চূড়ায় বসানো হয় একটি বেতার অ্যান্টেনা। এতে এর উচ্চতা আরও ২০.৭৫ মিটার (৬৬ ফুট) বেড়ে যায়। সেই থেকে আইফেল টাওয়ারকে বেতার তরঙ্গ প্রেরণের জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই বিস্ময়কর স্থাপত্যের মধ্যে ১২০টি আ্যন্টেনা রয়েছে। টাওয়ারটির একেবারে শীর্ষে ওঠার জন্য প্রায় ১,৬৬৫টি ধাপ রয়েছে। শীর্ষে ওঠার জন্য টাওয়ারটির মধ্যে স্থাপিত লিফট বা এলিভেটরও ব্যবহার করা হয়। রড আয়রন দিয়ে নির্মিত হওয়ার কারণে টাওয়ারটির ধাতব পদার্থ বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রা পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড়-ছোট হয়। উষ্ণতার কারণে গ্রীষ্মকালে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপমাত্রা বাড়লে এর আকার বেড়ে যায় প্রায় ৬.৭৫ ইঞ্চি। ঝড়ো হাওয়ায় এটি সর্বোচ্চ ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কাঁপতে পারে। নির্মাণকালীন পরিকল্পনায় টাওয়ারটি নির্মিত হয়েছিল ২০ বছরের জন্য। কিন্তু ফরাসি সামরিক বাহিনী ও সরকার রেডিও যোগাযোগের জন্য একে ব্যবহার শুরু করে। ১৯০৯ সালে প্যারিস শহর কর্তৃপক্ষ একে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। টাওয়ারটিতে কোনো নির্দিষ্ট রং ব্যবহার করা হয়নি। আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্য টাওয়ারটির উপরের অংশে কিছুটা গাঢ় রং ব্যবহার করা হয়। তবে নিচের দিকে ক্রমান্বয়ে হালকা রং ব্যবহার করা হয়। টাওয়ারটি রক্ষা করার জন্য প্রতি সাত বছর পর পর রং করা হয়। এতে ৫০ থেকে ৬০ টন রং ব্যবহার করা হয়, সম্পূর্ণভাবে রং করতে সময় লাগে প্রায় ১৮ মাস। আইফেল টাওয়ার, প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় ৫ মিনিটের জন্য ঝলমল করে ওঠে। টাওয়ারটির আলোকসজ্জায় প্রায় ৩৩৬টি প্রজেক্টর এবং ২০,০০০টি বাল্ব ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রথমে টাওয়ারের লিফট সচল ছিল না। আইফেল টাওয়ারে ১৮৮৯ সালের ৬ মে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। কিন্তু সে সময় ৩০ হাজার দর্শনার্থীকে ১,৬৬৫টি ধাপ পার হয়ে শীর্ষে পৌঁছাতে হয়। ইউনেস্কো ১৯৯১ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান হিসেবে এই টাওয়ারকে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের অন্য স্থাপনাগুলোর তুলনায় এখানে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী ঘুরতে আসে। প্রতি বছর এ টাওয়ার দেখতে প্রায় ৭০ লাখ দর্শনার্থী আসে, যাদের ৭৫ ভাগই আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। এ টাওয়ার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। টাওয়ারটির ভেতরে অবস্থিত দুটি রেস্তোরাঁ হলো লা ৫৮ টু্যর আইফেল এবং লা জুল ভার্ন। আইফেল টাওয়ার একটি বিশ্ববিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক, যেটি প্যারিসের প্রায় সমগ্র জায়গা থেকে দেখা যায়। এটি শুধু পর্যটনকেন্দ্রই নয় এখানে একটি সংবাদপত্র অফিস আছে। এ ছাড়া রয়েছে পোস্ট অফিস, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও একটা থিয়েটার। আইফেল টাওয়ারের প্রথম তলাটি প্রত্যেক বছর আইস রিংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া প্রথম মহাযুদ্ধের সময় এ টাওয়ারটি বেতার তরঙ্গ সম্প্রচার করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্যারিসে নাৎসি বাহিনীর আগমনের আগে লিফটের তার কেটে দিয়েছিল মিত্র বাহিনী। নাৎসিরা যেন টাওয়ারটি ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্যই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা ফিরে আসার পরে সেটি আবার ঠিক করা হয়েছিল। টাওয়ারটির সর্বোচ্চ তলায় একবার আগুনও লেগেছিল। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এই আইফেল টাওয়ার বিশ্বে নান্দনিক ঐতিহ্যের এক অংশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। গুস্তাভ আইফেল এ প্রসঙ্গে বলেন, 'এটি শুধু আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সৃষ্টি নয়, এটি এ শতাব্দীর শিল্প ও বিজ্ঞানের নিদর্শন।' টাওয়ারটি নির্মাণের সময় বহু ফটোগ্রাফার এর নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি তুলে রাখেন।