দ্বিতীয় অধ্যায়
২। গৌরী একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখেছিল। প্রামাণ্যচিত্রের প্রথম অংশে দেখল একটি সাঁজোয়া যান থেকে একদল লোক রাস্তার পাশের ঘুমন্ত মানুষ, মিছিলে অংশগ্রহণকারী মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। তারা দোকানপাট লুট করছে, ঘর-বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখে সে শিউরে উঠল এবং তাদের প্রতি ঘৃণার জন্ম হয়। শেষ অংশে দেখল দুজন লোক বসে আছে এবং একটি কাগজে স্বাক্ষর দিচ্ছেন। তখন চারদিকে 'জয় বাংলা ধ্বনিত হচ্ছিল। গৌরীর বাবা বললেন, 'এভাবেই আমরা পেয়েছি আমাদের প্রাণের স্বাধীন বাংলাদেশ।'
ক) নিয়মিত বাহিনী কী?
খ) অপারেশন জ্যাকপট বলতে কী বোঝায়?
গ) গৌরীর দেখা প্রমাণ্যচিত্রের প্রথম অংশ বাংলাদেশের কোন ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে? ব্যাখ্যা করো।
ঘ) গৌরীর বাবার বক্তব্যের যথার্থতা মূল্যায়ন করো।
উত্তর :
ক) বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের নিয়ে গঠিত বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী বলে।
খ) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৌপথে পরিচালিত অভিযানের নাম ছিল অপারেশন জ্যাকপট।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ১০নং সেক্টরের অধীনে অপারেশন জ্যাকপট অভিযানটি পরিচালিত হয়। এ অপারেশনে নৌ-কমান্ডোরা চট্টগ্রাম বন্দরে ১০টি এবং মোংলাবন্দরে ৫০টি পাকিস্তানি বাহিনীর জাহাজ ধ্বংস করে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নতুন গতি সৃষ্টি করেছিল।
গ) উদ্দীপকের গৌরীর দেখা প্রমাণ্যচিত্রের প্রথম অংশ ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর চালানো পাকিস্তানিদের গণহত্যা ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। স্বাধীনতাকামী বাঙালির মনোবল ভেঙে দিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা চালায়। এ রাতে ১১টা ৩০ মিনিটে ঢাকার সেনানিবাস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তাদের আক্রমণের প্রথম শিকার হয় ফার্মগেট এলাকায় রাস্তায় মিছিলরত মুক্তিকামী বাঙালি। একই সঙ্গে পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা ও হলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালানো হয়। ঢাকায় এই গণহত্যা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং ঢাকার বাইরে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা।
উদ্দীপকের গৌরীর দেখা প্রামাণ্যচিত্রে একটি গণহত্যার চিত্র উঠে এসেছে। নিরীহ মানুষের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাটের এ চিত্র ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ঘ) উদ্দীপকের গৌরীর বাবার বক্তব্যের যথার্থতা রয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ এবং ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে নতুন পথ দেখায়। মুক্তিপাগল বাঙালি তাদের সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ ছিল বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ, দেশকে মুক্ত করার যুদ্ধ যেখানে যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভেবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে সহায়তা করতে প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমাদের বিজয়ের চূড়ান্ত রূপ পায় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
উদ্দীপকের প্রামাণ্য চিত্রের দ্বিতীয় অংশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র উঠে এসেছে। মূলত এ দেশের সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ ও মুক্তির স্পৃহাই আমাদের বিজয়ের পথে প্রেরণা জুগিয়েছিল এবং পথকে মসৃণ করেছিল। যা শেষ হয় পাক-সেনাদের আত্মসমর্পণ এবং আমাদের বিজয়ের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, গৌরীর বাবার বক্তব্যের যথার্থতা আছে।
৩।
ক) আত্মসমর্পণ দলিলে যৌথবাহিনীর পক্ষে কে স্বাক্ষর করেন?
খ) 'গণহত্যার' ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।
গ) চিত্র-১ বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন ঘটনার প্রতিচ্ছবি?
ঘ) চিত্র-২ এ উলিস্নখিত বাহিনীর কার্যক্রমই কি এ দেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছিল? বিশ্লেষণ করো।
উত্তর :
ক) যৌথবাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণ দলিলে যৌথবাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করেন।
খ) গণ অর্থ জনগণ আর হত্যা অর্থ নির্বিচারে খুন করা। অর্থাৎ নির্বিচারে মানুষ বা জনগণকে খুন করাই হলো 'গণহত্যা'। জাতিসংঘের দৃষ্টিতে গণহত্যা হলো একটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় যা নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদাররা যে নির্মম হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
গ) চিত্র-১ বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রতিচ্ছবি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী (সেনাবাহিনী) ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের ওপর অত্যাচার ও আক্রমণ চালায়। ভয়াবহ সেই রাতে শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ, ছাত্র-শিক্ষকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। শুধু ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা শহরে ৭-৮ হাজার নিরীহ মানুষ অকাতরে প্রাণ হারায়। অন্যদিকে চিত্র-১ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ গণহত্যার দৃশ্য উঠে এসেছে। ১৯৩৯-১৯৪৫ সালব্যাপী এ মহাযুদ্ধে অসংখ্য গণহত্যার ঘটনা ঘটে। যাতে নিরপরাধ বহু মানুষ প্রাণ হারায়। একইভাবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী (সেনাবাহিনী) ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণ ঠেকানোর প্রস্তুতি বাঙালির ছিল না। ফলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ সারা দেশে চলে বাঙালি নিধন। ঢাকার বাইরেও এ আক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানিদের এই হত্যাযজ্ঞই প্রতিচ্ছবিই চিত্র-১ ফুটে উঠেছে।
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়