কান্তজীর মন্দির

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
কান্তজীর মন্দির
কান্তজীর মন্দির (কধহঃধলরৎ ঞবসঢ়ষব) বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এই মন্দিরটি বিভিন্ন নামে পরিচিত, কেউ কেউ একে কান্তজীউ মন্দির (কধহঃধলবি ঞবসঢ়ষব) বা কান্তনগর মন্দির নামে চিনেন আবার অনেকের কাছে নবরত্ন মন্দির নামেও পরিচিত। ১৮ শতকে নির্মিত মন্দিরটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরবর্তী গ্রাম কান্তনগরে মন্দিরটির অবস্থান। দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরটি মধ্যযুগীয় এক নিদর্শন। মহারাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি শ্রীকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী রুক্মিণীকে উৎসর্গ করে নির্মিত করেন। এটির নির্মাণ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র রাজা রামনাথ রায়ের রাজত্বকালে শেষ হয়। মন্দিরটির নবরত্ন বা 'নয় শিখর' ছিল। কিন্তু ১৮৯৭ সালের একটি ভূমিকম্পে সবগুলোই ধ্বংস হয়ে যায়। এ মন্দিরে বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে মন্দিরের দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাজ প্রাণনাথ এই মন্দির নির্মাণের জন্য সুদূর পারস্য থেকে নির্মাণশিল্পী এনেছিলেন। এই শিল্পীদের আনা হয়েছিল মূলত মন্দিরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে নয়াবাদ নামক গ্রামে রাজ প্রাণনাথ নির্মাণশিল্পী এবং শ্রমিকদের বসবাসের জন্য জমি দান করেন। এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাই ধর্মীয় প্রার্থনা পালনের জন্য তারা নয়াবাদ মসজিদ নির্মাণ করেন যা একই এলাকার আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে মন্দির প্রাঙ্গণে এক মাসব্যাপী রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, মহারাজা রামনাথ রায়ের সময়কাল থেকেই এই রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলা চলাকালীন অনেক তীর্থ যাত্রী ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মন্দিরে তীর্থ যাত্রা করেন। মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃতু্যর পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূড়াগুলো ভেঙে যায়। বিশ শতকের শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি। মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী চিত্রায়ণ করা আছে। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫,০০০-এর মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে। উপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি। মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দুটো ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে। বাংলাদেশে যত পুরনো মন্দির রয়েছে সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রাচীন মন্দিরটির বয়স প্রায় ৩০০ বছর। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক এটি দেখতে ভিড় জমান। নির্মাণশৈলীর জন্য দেশ-বিদেশের পর্যটকদের মধ্যে এই প্রাচীন মন্দিরের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। স্থাপত্য রীতি, গঠনবিন্যাস, শৈল্পিক মন্দিরটির সামগ্রিক দৃশ্যকে এতই মাধুর্যমন্ডিত করে তুলেছে, এর চেয়ে নয়নাভিরাম মন্দির দেশে দ্বিতীয়টি নেই।