ইতিহাস ও ঐতিহ্য

হোসেনী দালান

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
হোসেনী দালান বা ইমামবাড়া রাজধানী ঢাকার বকশীবাজারে অবস্থিত একটি শিয়া উপাসনালয় এবং কবরস্থান। হোসেনী দালান বা ইমামবাড়া মূলত কারবালার প্রান্তরে শাহাদাতবরণকারী ঈমাম হোসেনের স্মৃতির স্মরণে নির্মিত শিয়া সম্প্রদায়ের একটি উপাসনালয়। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত এই স্থাপনাটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। অনুমান করা হয় ১৭শ' শতকে মোগল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে হোসেনী দালান ভবনটি নির্মাণ করা হয়। হোসেনী দালানের বিকল্প উচ্চারণ হুস্নী দালান এবং ইমারতের গায়ে শিলালিপিতে ফারসি ভাষায় লিখিত কবিতা অনুসারে উচ্চারণ হোসায়নী দালান। এটি মোগল শাসনামলের একটি স্থাপনা। ইমারতটি মুহাম্মাদের পৌত্র হুসাইন বিন আলী শহীদ হওয়ার স্মরণে নির্মিত। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো এ স্থাপনা মোগল আমলের ঐতিহ্যের নিদর্শন। মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ইমামবাড়ার দেয়ালের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তার এক নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ এটি হিজরি ১০৫২ সনে (১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) সৈয়দ মীর মোরাদ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি প্রথমে তাজিয়া কোনা নির্মাণ করেন। ইমামবাড়া তারই পরিবর্ধিত রূপ। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উলেস্নখ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটি নকল নয়। শিলালিপিতে উলেস্নখ রয়েছে নির্মাতা হিসেবে মীর মুরাদের নাম। ঐতিহাসিক এম হাসান দানীও বলেছেন, 'মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। পরে এটি ভেঙে যায় এবং নায়েব-নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন। ইতিহাসবিদ জেমস টেলর তার বইয়ে উলেস্নখ করেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকেছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউলস্নাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করেন। ১৯৯৫-এ একবার এবং পরবর্তীতে ২০১১-তে পুনর্বার দক্ষিণের পুকুরটির সংস্কার করা হয়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় হোসেনী দালান ইমামবাড়ার সংস্কার সাধন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। ইরান সরকারের উদ্যাগে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে হোসেনী দালানের ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়। ইরান সরকার এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। ফলে ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে। সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা চারুলিপি। ইরানের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনায় এ ধরনের টাইলস রয়েছে বলে জানা যায়। হোসেনী দালানের দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃতির পুকুর। এর উত্তরাংশে শিয়া বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের কবরস্থান অবস্থিত। দালানটি সাদা বর্ণের এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের চারুলিপির কারুকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরেও সুদৃশ্য নকশা বিদ্যমান। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হোসেনী দালানের তোরণ দিয়ে প্রবেশ করলে শিয়া সম্প্রদায়ের কবরস্থান, মূল ভবন এবং একটি বিশাল বাগান দেখতে পাওয়া যায়। আর মূল ভবনের পেছনে রয়েছে একটি দীঘি। জাতীয় জাদুঘরে হোসেনী দালানের রূপা দিয়ে তৈরি একটি রেপিস্নকা রাখা আছে। প্রতি বছর মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন পবিত্র আশুরা উপলক্ষে হোসেনী দালান উৎসব মুখরিত হয়ে উঠে। সে সময় এখানে বিভিন্নরকম অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এছাড়াও মহররমের ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল এখান থেকেই যাত্রা করে।