ভ্যাটিকান সিটির ইতিহাসের সূচনা হয় চতুর্থ শতাব্দীতে যদিও তখন এর কোনো চিহ্নিত সীমান্ত ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থার ব্যানারে পোপরা ইতালীয় উপদ্বীপ, রোম এবং এর আশপাশের অঞ্চল প্রায় ১০০০ বছর ধরে শাসন করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত পোপতান্ত্রিক সম্রাজ্য ইতালির কেন্দ্রীয় একটি বিশাল অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৮৬০ সালে ভিক্টর ইমানুয়েলের সেনাদল রোম এবং এর সাথে লাগোয়া কিছু অঞ্চল ছাড়া সমগ্র ইতালি অধিকার করে নেয় এবং এতেই বিস্তৃত পোপতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের পতন হয়।
ভ্যাটিকান সিটি ইতালির রাজধানী রোম শহরের ভিতরে অবস্থিত স্বাধীন রাষ্ট্র ও ছিটমহল। ভ্যাটিকান নগর রাষ্ট্র, যা সাধারণত ভ্যাটিকান নামেই অধিক পরিচিত। ল্যাটেরান সন্ধির মাধ্যমে ইতালি থেকে এটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯২৯ সালে, যা হলি সি এর একটি পূর্ণ মালিকানাধীন, সার্বভৌম বিচার বিভাগীয় ও প্রশাসনিক অঞ্চল। পোপ এখানকার রাষ্ট্রনেতা। এটি রোমান ক্যাথলিক গির্জার বিশ্ব সদর দফতর হিসেবে কাজ করে। সম্পূর্ণভাবে রোমের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভ্যাটিকান সিটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র, যার আয়তন ১২১ একর।
উত্তর-পশ্চিম রোমের ভ্যাটিকান পাহাড়ের ওপর একটি ত্রিভুজাকৃতির এলাকায়, তিবের নদীর ঠিক পশ্চিমে, ভ্যাটিকান শহর অবস্থিত। দক্ষিণ-পশ্চিমের পিয়াৎসা সান পিয়েত্রো বা সেন্ট পিটার চত্বর বাদে বাকি সবদিকে ভ্যাটিকান শহর মধ্যযুগ ও রেনেসাঁর সময়ে নির্মিত প্রাচীর দিয়ে রোম শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রাচীরের ভেতরে আছে উদ্যান, বাহারী দালান ও চত্বরের সমাবেশ। সবচেয়ে বড় দালানটি হলো সেন্ট পিটারের ব্যাসিলিকা, যা রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান গির্জা। ভ্যাটিকান সিটিতে রয়েছে একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, লাইব্রেরি ভ্যাটিকানা।
ভ্যাটিকান সিটির নিজস্ব সংবিধান, ডাকব্যবস্থা, সীলমোহর, পতাকা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতীক বিদ্যমান। ভ্যাটিকানের নিজস্ব সেনাবাহিনীও আছে, যার নাম সুইস গার্ড; এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০০। ভ্যাটিকান রেডিও নামের সরকারি বেতার স্টেশন সারা বিশ্বে পোপের কণ্ঠ ছড়িয়ে দেয়। ২০০১ সালে ভ্যাটিকান শহরে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০০০। এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে ও পোপের দেয়া বিশেষ দায়িত্ব পালন করে এখানকার নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব।
ভ্যাটিকান সিটি শেষ পোপীয় রাষ্ট্র। ক্যাথলিক গির্জা বহু শতাব্দী ধরে মধ্য ইতালির বেশ কিছু এলাকাতে এই রাষ্ট্রগুলো স্থাপন করেছিল, যার শাসনকর্তা ছিলেন পোপ। ইতালীয় সরকার ও পোপ সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু বছর ধরে বিতর্কের পর ১৯২৯ সালে লাতেরান চুক্তির অধীনে ভ্যাটিকান সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চুক্তির অধীনে ক্যাথলিক গির্জা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে অন্য সব পোপীয় রাষ্ট্র থেকে দাবি প্রত্যাহার করে নেয় এবং স্বাধীন ভ্যাটিকান সিটি হিসেবে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে।
ভ্যাটিকান সিটি নামটি প্রথম ল্যাটেরান সন্ধিতে ব্যবহৃত হয় যা ১১ ফেব্রম্নয়ারি ১৯২৯ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধির মাধ্যমে আধুনিক ভ্যাটিকান নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। যার নামকরণ হয় ভ্যাটিকান পর্বতের নামানুসারে। 'ভ্যাটিকান' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে এটরুস্টান বসতির নামানুসারে, রোমানদের কাছে এগার ভ্যাটিকানাস বা ভ্যাটিকান অঞ্চল নামে পরিচিত এলাকায় ভ্যাটিকা বা ভ্যাটিকাম নামে এই মানববসতির অবস্থান ছিল। দাপ্তরিকভাবে ইতালিয়ান ভাষায় শহরটির নাম সিত্তা ডেল ভাটিকানো বা স্তাতো দেলস্না সিত্তা দেল ভাটিকানো। যার সরলার্থ 'ভ্যাটিকান নগর রাষ্ট্র'। যদিও হোলি সি (যা ভ্যাটিকান থেকে পৃথক) দাপ্তরিক কাজে যাজকীয় লাতিন ব্যবহার করে, ভ্যাটিকান নগরের দাপ্তরিক ভাষা ইতালীয়। নগরটির লাতিন নাম 'স্ট্যাটাস সিভিয়াটিস ভাটিকানো', এই নামটিই হোলি সি, চার্চ এবং পোপ ব্যবহার করে থাকেন।
খ্রিষ্ট ধর্মের প্রবর্তনের আগে থেকেই এই রাজ্যের স্থানটুকুকে পবিত্র বলে গণ্য করা হতো এবং রোমের এই অংশটুকুতে এর আগে কখনই বসতি গড়ে উঠেনি বা কেউ এখানে বসতি স্থাপন করতে চায়নি। রোমান সাম্রাজ্যের সময় এই স্থানে ফ্রিজিয়ান দেবী সিবেল এবং তার স্বামী আটিসের উপাসনা করা হতো। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে আগ্রিপিনা দ্য এলডার (খ্রিষ্টপূর্ব ১৪-৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) এই অঞ্চলের একটি পাহাড় কেটে বিশাল উদ্যান তৈরি করেন। পরবর্তীতে সম্রাট ক্যালিগুলা এখানে একটি সারকাস তৈরির উদ্যোগ নেন যদিও তিনি তা সম্পূর্ণ তৈরি করে যেতে পারেননি। তার পরবর্তী সম্রাট নিরো এই সার্কাস সম্পন্ন করেন। এই সার্কাসটিকে তাই 'নিরোর সার্কাস' (সার্কাস অফ নিরো) নামে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে সেই ভ্যাটিকানের একমাত্র দৃশ্যমান ভগ্নাবশেষ হচ্ছে ভ্যাটিকান ওবেলিস্ক। এই ওবেলিস্কটি সম্রাট ক্যালিগুলা হেলিওপলিস থেকে ভ্যাটিকানে নিয়ে এসেছিলেন তার সার্কাসের স্পিনা সাজানোর জন্য। ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমে বৃহৎ অগ্নিকান্ডে শহীদ খ্রিষ্টানদের সমাধিস্থল হিসেবে এই স্থানটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রাচীন প্রথাগত বিশ্বাস অনুসারে বলা হয় এই সার্কাসের প্রান্তরেই সেন্ট পিটারকে মাথা নিচে ও পা উপরে দিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। সার্কাসের বিপরীত দিকে ছিল একটি সমাধিসৌধ, যা ভিয়া করনেলিয়া দ্বারা সার্কাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল। এই ভ্যাটিকানেই বহুত্ববাদী ধর্মগুলোর (যেমন- প্যাগান ধর্ম) উপাসনালয়, শেষকৃত্যের সৌধ এবং অন্যান্য সৌধ ও মিনার নির্মিত হয়েছিল। এই সবকিছু নির্মিত হয়েছিল চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের আগে। চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমভাগে সম্রাট কন্স্টান্টাটাইন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং তিনিই ভ্যাটিকানের কেন্দ্রভূমিতে সেন্ট পিটারের ব্যাসিলিকা নির্মাণ করেন। তখন ভ্যাটিকানের প্যাগান স্থাপনাসমূহ ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই ব্যাসিলিকাটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পোপদের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে ব্যাসিলিকার মূল স্থাপনা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষত রেনেসাঁর সময় এর খননকাজ দ্রম্নত এগোতে থাকে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে পোপ দ্বাদশ পিউস-এর নির্দেশে সম্পূর্ণ স্থাপনাটি ভূমি থেকে উত্তোলিত করা হয়।
পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়