পঞ্চম অধ্যায়
কোনো একটি অঞ্চলের সাধারণত ৩০-৪০ বছরের গড় আবহাওয়ার অবস্থাকে জলবায়ু বলে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদানগুলো হলো বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর আর্দ্রতা ও বারিপাত। যে অদৃশ্য বায়ু পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে তাই বায়ুমন্ডল। পৃথিবীর জীবকূলের জীবনধারণের জন্যে বায়ুমন্ডল অপরিহার্য। বিভিন্ন গ্যাসের মিশ্রণে এ বায়ুমন্ডল গঠিত। বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেন (ঘ২) এর শতকরা হার ৭৮.০২ ভাগ, অক্সিজেন (ঙ২) ২০.৭১ ভাগ এবং বাকি ১.২৭ ভাগ অন্যান্য গ্যাস।
ঘনত্ব ও উপাদানের ভিত্তিতে বায়ুমন্ডলকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- ট্রপোমন্ডল, স্ট্রাটোমন্ডল, মেসোমন্ডল, তাপমন্ডল ও এক্সোমন্ডল। কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানের বায়ুর তাপ, চাপ, আর্দ্রতা, মেঘাচ্ছন্নতা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহের দৈনন্দিন সামগ্রিক অবস্থাকে সেই দিনের আবহাওয়া বলে। কোনো একটি অঞ্চলের সাধারণত ৩০-৪০ বছরের গড় আবহাওয়ার অবস্থাকে জলবায়ু বলে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদানগুলো হলো বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর আর্দ্রতা ও বারিপাত।
বায়ুমন্ডল : পৃথিবীর চারদিক নানা প্রকার গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা বেষ্টিত। অদৃশ্য এই গ্যাসীয় আবরণ যা পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে তাই বায়ুমন্ডল। ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বায়ুমন্ডল বিস্তৃত।
বায়ুর উপাদান : বায়ু কতকগুলো গ্যাসের মিশ্রণ। এ গ্যাসগুলোর মধ্যে প্রধান হলো- নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন। এছাড়া বায়ুর মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয়বাষ্প, খুব সামান্য পরিমাণে আরগন, নিয়ন, হিলিয়াম, ক্রিপটন, জেনন, ওজোন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড বর্তমান আছে।
বায়ুমন্ডলের স্তরবিন্যাস : বায়ুমন্ডল যে সমস্ত উপাদানে গঠিত তাদের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও উষ্ণতার পার্থক্য অনুসারে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে বায়ুমন্ডলকে পর্যায়ক্রমে ট্রপোমন্ডল, স্ট্রাটোমন্ডল, মেসোমন্ডল, তাপমন্ডল ও এক্সোমন্ডল এ পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়।
আবহাওয়া : কোনো নির্দিষ্ট স্থানের কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা, বায়ুপ্রবাহ, জলীয়বাষ্প ও বৃষ্টিপাতের একত্রিত অবস্থাকে আবহাওয়া বলে।
জলবায়ু : কোনো বৃহৎ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের অন্ততপক্ষে ৩০-৪০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে জলবায়ু বলে।
জলবায়ুর নিয়ামক : পৃথিবীর সব অঞ্চলের জলবায়ু একই রকম নয়। কিছু ভৌগোলিক পার্থক্যের কারণে স্থানভেদে জলবায়ুর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই বিষয়গুলোকে জলবায়ুর নিয়ামক বলে।
পানিচক্র : সূর্যের তাপে সাগর-মহাসাগর, নদীনালা, পুকুর-জলাশয় ইত্যাদির পানি বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে যায়। ওই পানি বৃষ্টি হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। একে পানি চক্র বলে।
বাষ্পীভবন : বাষ্পীভবনের দ্বারা জলীয়বাষ্পের সৃষ্টি হয়। সমুদ্র জলীয়বাষ্পের প্রধান উৎস। এছাড়া উদ্ভিদ জগৎ, নদী ও অন্যান্য জলাশয়ের পানি সূর্যের তাপে ক্রমাগত বাষ্পে পরিণত হয়ে ঊর্ধ্ব বায়ুমন্ডলে মিশে যায়। একে বাষ্পীভবন বলে।
ঘনীভবন : কোনো কারণে পরিপৃক্ত বায়ু শীতল হতে থাকলে পূর্বের মতো বেশি জলীয়বাষ্প ধরে রাখতে পারে না। তখন জলীয়বাষ্পের কিছুটা পানিতে পরিণত হয়। একে ঘনীভবন বলে।
বায়ুর আর্দ্রতা : বায়ুতে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতিকে বায়ুর আর্দ্রতা বলে।
বৃষ্টিপাত : জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু ওপরে উঠে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয় এবং তা ঊর্ধ্বাকাশে ভাসতে থাকে। মেঘের মধ্যে থাকা অসংখ্য পানির কণা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে বৃষ্টির আকারে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। এরূপ একসাথে অসংখ্য জলকণা ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়াকে বৃষ্টিপাত বলে।
পরিচলন বৃষ্টি : দিনের বেলায় সূর্যের কিরণে পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে সোজা উপরে উঠে যায় এবং শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে ওই জলীয়বাষ্প প্রথমে মেঘ ও পরে বৃষ্টিতে পরিণত হয়ে সোজাসুজি নিচে নেমে আসে। এরূপ বৃষ্টিপাতকে পরিচলন বৃষ্টি বলে।
শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি : জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু স্থলভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় যদি গমনপথে কোনো উঁচু পর্বত শ্রেণিতে বাধা পায় তাহলে ওই বায়ু উপরের দিকে উঠে যায়। তখন জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু ক্রমশ প্রসারিত হয় এবং পর্বতের উঁচু অংশে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে পর্বতের প্রতিবাত ঢালে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এরূপ বৃষ্টিপাতকে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি বলে।
বায়ু প্রাচীরজনিত বৃষ্টি : শীতল ও উষ্ণ বায়ু মুখোমুখি উপস্থিত হলে উষ্ণ বায়ু এবং শীতল বায়ু একে অপরের সঙ্গে মিশে না গিয়ে তাদের মধ্যবর্তী এলাকায় অদৃশ্য বায়ু প্রাচীরের সৃষ্টি করে। এ বায়ু প্রাচীরের সংযোগস্থলে যে বৃষ্টিপাত হয়, তাকে বায়ু প্রাচীরজনিত বৃষ্টি বলে।
ঘূর্ণি বৃষ্টি : ঘূর্ণিবাত কেন্দ্রের বায়ু উপরে উঠে যাওয়ায় এর তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং শীতল হয়। এ সময় বায়ুর অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এরূপ বৃষ্টিপাতকে ঘূর্ণি বৃষ্টি বলে।
বায়ুপ্রবাহ : বায়ুর তাপ ও চাপের পার্থক্যের জন্য বায়ু এক জায়গায় নিশ্চল থাকে না। সর্বদা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয়। একে বায়ুপ্রবাহ বলে।
নিয়ত বায়ুপ্রবাহ : যে বায়ু পৃথিবীর চাপ বলয়গুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সারাবছর নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয় তাকে নিয়ত বায়ু বলে।
অয়ন বায়ু : কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় হতে দুটি বায়ুপ্রবাহ নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে সবসময় প্রবাহিত হয়। অয়ন বায়ু পৃথিবীর আবর্তনের জন্য ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে বেঁকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। এ বায়ুকে বাণিজ্য বায়ুও বলা হয়।
প্রত্যয়ন বা পশ্চিমা বায়ু : কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় হতে আরও দুটি বায়ুপ্রবাহ সুমেরু ও কুমেরুবৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়। এ বায়ু উত্তর গোলার্ধে উত্তর মেরুর দিকে আসতে আসতে পৃথিবীর আবর্তনের জন্য ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুপ্রবাহ এবং দক্ষিণ গোলার্ধে কুমেরুবৃত্তের নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় বাম দিকে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম বায়ুপ্রবাহে পরিণত হয়। এগুলোকে যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম প্রত্যয়ন বায়ু বা পশ্চিমা বায়ু বলে।
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়