মুঘল সাম্রাজ্য

মির্জা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
মির্জা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট। যিনি ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ইনি মহান শাসকদের অন্যতম হিসেবে মহামতি আকবর নামেও পরিচিত। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃতু্যর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে তিনি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। ১৫৬০ সালে বৈরাম খাঁকে সরিয়ে আকবর নিজে সকল ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু আকবর ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে তার সাম্রাজ্য বিস্তার চালিয়ে যান। সাম্রাজ্যের রাজপুতদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার স্বার্থে আকবর বিভিন্ন রাজবংশের রাজকন্যাদের বিয়ে করেন। তবে তার স্ত্রীদের মধ্যে সবচাইতে আলোচিত হলেন যোধা বাঈ। রাজ্য শাসনের জন্য আকবর আমলাতন্ত্র চালু করেন এবং প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দান করেন। আকবরের আমলাতন্ত্র বিশ্বের সব থেকে ফলপ্রসূ আমলাতন্ত্রের মধ্যে অন্যতম। তিনি প্রত্যেক অঞ্চলে সামরিক শাসক নিয়োগ দেন। প্রত্যেক শাসক স্বশাসিত প্রদেশের সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। সম্রাট আকবর শাসিত সাম্রাজ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের শাস্তি ছিল একমাত্র মৃতু্যদন্ড। রাজপুতরা শত্রম্ন হিসাবে ছিল প্রবল, কিন্তু বন্ধু হিসেবে ছিল নির্ভরযোগ্য। আকবরের শাসনকালে তিনি রাজপুতদের সাথে সন্ধি করার প্রয়াস করেছিলেন। কিছুটা যুদ্ধের দ্বারা, এবং অনেকটাই বিবাহ সূত্রের দ্বারা তিনি এই প্রয়াসে সফল হয়েছিলেন। আমেরের রাজা ভরমল কন্যা জোধাবাঈ এর সাথে তার বিবাহ হয়। ভরমলের পুত্র রাজা ভগবান দাস আকবরের সভায় নবরত্নের একজন ছিলেন। ভগবান দাসের পুত্র রাজা মান সিংহ আকবরের বিশাল সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন। রাজা টোডর মল ছিলেন আকবরের অর্থমন্ত্রী। আরেক রাজপুত, বীরবল, ছিলেন আকবরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও প্রিয়পাত্র। বেশির ভাগ রাজপুত রাজ্য যখন আকবরের অধীনে চলে আসছে, তখন একমাত্র মেওয়ারের রাজপুত রাজা মহারানা উদয় সিংহ মুঘলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। চিতোরের পতনের পর তিনি উদয়পুর পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে রাজপুতদের একত্রিত করতে চেষ্টা করেন। তার পুত্র মহারানা প্রতাপ সিংহ সারাজীবন মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতাপ আকবরের আনুগত্য মেনে না নিলেও, চিত্ত্বর দুর্গে আকবর আক্রমণ করার পর তারা পালিয়ে যায় এবং উদয়পুরে রাজ্য স্থাপন করে। রাজপুতদের কখনো একত্রিতও করতে পারেনি। এছাড়াও প্রতাপ সিং চিত্ত্বর দুর্গ পুনঃরুদ্ধার করতে পারেনি। মেবারের রাজপুতরাই একমাত্র রাজপুত জাত যারা রাজ্য হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তবুও আকবরের প্রতি আনুগত্য মেনে নেয়নি। আকবর প্রতাপের বোন কওম কে বিয়ে করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেননি। আকবর তার নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দীন-ই-ইলাহি নামক ধর্ম চালু করার চেষ্টা করেন। দীন-ই-এলাহির প্রাথমিক শিষ্যরা হলো, আকবরের সময়কালে : বীরবল, যুবরাজ সেলিম, আবুল ফজল ইবন মুবারক, যুবরাজ মুরাদ, কাশিম খান, আজম খান, শেখ মুবারাক, আবদুস সামাদ, মোলস্না শেখ মোহাম্মদ শাহাদাত, সুফি আহমেদ, মির শরিফ আমল,সুলতান খাজা, মির্জা সদরুদ্দিন, তাকি সুস্তার, শেখজাদা গোসলা বেনারসি, সদর জাহান, সদর জাহানের প্রথম ছেলে, সদর জাহানের দ্বিতীয় ছেলে- শেখ ফয়েজি ও জাফর বেগ। শিল্পকলার ইতিহাসেও আকবরের আমল এক স্মরণীয় অধ্যায়। তার আমলে বহু প্রাসাদ, সমাধি, উদ্যান ও দুর্গ নির্মিত হয়। তার আমলে নির্মিত ফতেপুর সিক্রি, সেলিম চিস্তির সমাধি, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জামি মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা, হুমায়ুনের সমাধি, সেকেন্দ্রার সমাধি ভবন উলেস্নখযোগ্য। ফতেপুর সিক্রির স্থাপত্য- সৌন্দর্যকে ফাগুসন মহৎ প্রাণের প্রতিবিম্ব' বলে অভিহিত করেছেন। ড. স্মিথ-এর মতে, তা হল 'পাথরে নির্মিত কল্পনা ও স্বপ্ন'। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও আকবরের রাজত্বকাল এক উলেস্নখযোগ্য অধ্যায়। চিত্রশিল্পের প্রসারের জন্য তিনি আবদুস সামাদ-এর নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করেন। তার আমলে চিত্রশিল্পে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। তিনি প্রায় একশ' জন হিন্দু -মুসলিম শিল্পীর পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। তার আমলের ১৭ জন বিখ্যাত শিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন হিন্দু। হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন তারাচাঁদ, জগন্নাথ, যশোবন্ত। তারা পারসিক গল্প, রামায়ণ-মহাভারত ও আরব্য উপন্যাসের নানাবিধ কাহিনী চিত্রে রূপায়িত করতেন। আকবরের সভাসদদের মধ্যে নবরত্ন হিসেবে যারা ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছেন, টোডরমল, ফতুলস্নাহ শিরাজী, তানসেন, বীরবল, আবুল ফজল, কবি ফৈজি,আব্দুল রহিম খান,ফকির আজিওদ্দিন, সেনাপতি মানসিংহ ও মোলস্না দো-পেঁয়াজা। ১৬০৫ সালে তার মৃতু্যর আগ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত তার সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। আকবরের মৃতু্যর পর তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেন ও সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।