সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়...

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
আলাউদ্দিন আলী
যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়, সে হারাল কোথায় কোন দূর অজানায়...।' নিজের সুর করা এই গানের মতোই দূর অজানায় হারিয়ে গেছেন বাংলা সংগীতের দিকপাল ও অসংখ্য গানের সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন আলী। সোমবার রামপুরা ও আলাউদ্দীন আলীর আবাসস্থল খিলগাঁওয়ের নূর-ই-বাগ মসজিদ ও এফডিসি প্রাঙ্গণে জানাজার পরপরই মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় বাংলা গানের এই প্রাণভোমরাকে। এর আগে রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক। ঢাকাই চলচ্চিত্রের হৃদয়কাড়া বহু গানের এই গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের প্রদাহ ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যায় ভুগছিলেন। তার মৃতু্যর খবরে শোকে মুষড়ে পড়েছে সংগীতাঙ্গন। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ প্রমুখ। আলাউদ্দিন আলীর বর্ণাঢ্য জীবন ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে বাবার ভাড়া বাসায় তার জন্ম। পৈতৃক ভিটা মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে। তার বাবা ওস্তাদ জাদব আলীও ছিলেন গানের মানুষ। চাকরি করতেন বাংলাদেশ বেতারে। মায়ের নাম জোহরা খাতুন। সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে আলাউদ্দিন আলী পরিচিত হলেও ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বেহালাবাদক হিসেবে। তার বেহালার সুরে মুগ্ধ হতেন সবাই। শৈশবে বেহালা বাজানোর জন্য 'অল পাকিস্তান চিলড্রেন্স' প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে বেহালাবাদক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন আলাউদ্দিন আলী। শুরুতেই প্রয়াত কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদের সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। পরে প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের সঙ্গেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত দেশাত্মবোধক গান 'ও আমার বাংলা মা' তার পরিচালিত প্রথম গান। ১৯৭৫ সালে 'সন্ধিক্ষণ' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ ঘটে আলাউদ্দিন আলীর। এরপর ১৯৭৭ সালে 'গোলাপি এখন ট্রেনে' আর 'ফকির মজনু শাহ' চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসিত হন তিনি। সেই শুরু, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একে একে কালজয়ী বহু গান তৈরি করে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য এক উচ্চতায়। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সাতবার সংগীত পরিচালক ও একবার গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন আলাউদ্দীন আলী। দীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ারে প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের গানসহ প্রায় পাঁচ হাজার গান তৈরি করেছেন তিনি। সুরস্রষ্টার কালজয়ী কিছু সৃষ্টি অসংখ্য কালজয়ী গানের সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী। তার উলেস্ন্যযোগ্য গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'একবার যদি কেউ ভালোবাসতো', 'যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়', 'প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ', 'ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়', 'দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়', 'আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার', 'সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ', 'বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম দেখা পাইলাম না', 'যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে', 'এমনও তো প্রেম হয়', 'চোখের জলে কথা কয়', 'কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না', 'জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো' ইত্যাদি। সুরকার আলাউদ্দিন আলী দেহত্যাগ করলেও তার সুর- তৈরি করা গান যুগ যুগ ধরে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে শ্রোতাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়। কিংবদন্তির অপ্রকাশিত গানগুলো আলাউদ্দিন আলীর স্ত্রী ফারজানা আলী গত ১৭ জুন এক সাক্ষাৎকারে জানান, শরীর খারাপ নিয়েও সাতটি গান লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আলী। তার মধ্যে দুটি গানের সুরও করেছেন। শুধু মুখটার সুর দিয়েছেন। এমনকি করোনা নিয়েও একটি গান লিখেছেন তিনি। সেই গানের কথাগুলো- 'ফিরে যাও শান্তি দাও, আমরা বাঁচতে চাই/ তোমার কারণে বন্দি আমরা, এইবার মুক্তি চাই। মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস; আমাদের খুব প্রিয়/ অনেক হয়েছে এবার তুমি/ মুক্তি এনে দিও। জ্ঞানী-গুণী হারিয়েছি আমরা এবার তুমি থামো/ বাঁচার অধিকার আছে সবার, এ কথাটি মানো।' গত ৪ জুনেও একটি গান লিখেছেন আলাউদ্দিন আলী। গানটি রোমান্টিক। ফারজানা আলী বলেন, 'সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। এই মুডই সেই গানটিতে তিনি রেখেছেন। গানের মুখ এরকম- 'ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরে, মেঘ বয়ে যায়/ হারানো প্রিয়তমা মন খোঁজে তোমায়। কোনো এক বৃষ্টি রাতে, হারিয়েছিলে তুমি/ সেই থেকে একা হয়ে আজও আছি আমি।' শুধু তাই নয়, গানের জন্য স্টুডিওতেও ফিরেছিলেন তিনি। বেশ আনন্দ নিয়ে তার সেই ফেরার খবর প্রকাশ করেছিল এদেশের সংবাদমাধ্যম। ২০১৯ সালের আগস্টের এক সন্ধ্যায় ফুয়াদ নাসের বাবুর স্টুডিওতে হাজির হয়েছিলেন তিনি। একটি দেশের গানের রেকর্ডিং করেছেন। 'মুক্তিযুদ্ধ চেতনায় দীপ্ত, পিতার পতাকা হাতে'- এমন কথার গানটি লিখেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। প্রয়াত কবির লেখা এই গানটির সুর করেছেন আলাউদ্দিন আলী। গানটির সংগীতায়োজন করেছেন ফুয়াদ নাসের বাবু। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন আলাউদ্দিন আলীর স্ত্রী সংগীতশিল্পী ফারজানা আলী মিমি। তখন জানা গিয়েছিল অনেক দিন আগেই এ গানটির সুর করেছিলেন আলাউদ্দিন আলী। অল্প কিছু কাজ বাকি ছিল। তার অসুস্থতার জন্যই সেই কাজ পড়েছিল। সুস্থ হয়েই আবারও গানটির সুরারোপ শেষ করে দেন তিনি। তবে সেই গান প্রকাশ হয়নি এখনো। তার আগেই চলে গেলেন এর সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন আলী।