দুই দশকের আলোচিত যত সিনেমা

প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

রায়হান রহমান
একুশ শতকের শুরু থেকেই দেশীয় বাংলা সিনেমায় পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। পাল্টে গেছে গল্প ও চিত্রনাট্যের ধারাও। বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি তথাকথিত বিকল্প কিংবা মনস্তাত্বিক সিনেমাগুলোও বক্স অফিস কাঁপাচ্ছে। গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে সিনেমাগুলো বাস্তবতা ও সাধারণ মানুষের কথা বলারও চেষ্টা করছে। গল্পশৈলী, সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিংয়ের নতুনত্ব, লোকেশন নির্বাচন ও জুতসই অভিনয় দিয়ে একুশ শতকে দর্শকের মন জয় করা এমন কয়েকটি সিনেমার আদ্যোপান্ত থাকছে আজ। শুরু থেকেই শুরু করা যাক। ২০০১ সালে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন 'লালসালু'। গ্রামীণ মানুষের কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে যুগ যুগ ধরে এক শ্রেণির মানুষ প্রতারণা করে আসছে; সেই দৃশ্যই ফুটে উঠেছে এ সিনেমায়। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। নিঃসন্দেহে এটি একুশ শতকের অন্যতম সেরা একটি সিনেমা। সেটা প্রমাণ করেছে একাধিক ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে। তারেক মাসুদ ২০০২ সালে নির্মাণ করেন 'মাটির ময়না'। এতে ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার দৃশ্য আঁকা হয়েছে। পুরো সিনেমাজুড়ে ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্ধৃতি থাকলেও সেগুলো এক কিশোরের মানবিক অভিজ্ঞতায় প্রকাশিত হয়েছে। ছবিটির গল্পের দূরদর্শিতার কারণে কান চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়। এতে অভিনয় করেন নুরুল ইসলাম বাবলু, রাসেল ফরাজী, রোকেয়া প্রাচী, শোয়েব ইসলাম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লামিসা রিমঝিম প্রমুখ। ঔপন্যাসিক নাসরীন জাহানের উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৪ সালে নির্মিত হয় 'শঙ্খনাদ'। চলচ্চিত্র নির্মাতা আবু সাইয়ীদ এটি তৈরি করেন। এতে অভিনয় করেন জাহিদ হাসান, কে এস ফিরোজ, নাজমা আনোয়ার, ফজলুর রহমান বাবু, রেবেকা দিপা, মিরানা জামানের মতো অভিনয় শিল্পীরা। চারটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় 'আহা'। ছবিটি নির্মাণ করেন এনামুল করিম নির্ঝর। জনবহুল ঢাকা শহরের দ্রম্নত বদলে যাওয়ার গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে 'আহা'। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, ফজলুর রহমান বাবু, শহিদুল আলম সাচ্চু, ইয়াসমিন বিলকিস সাথী, ফেরদৌস (অতিথি শিল্পী), প্রজ্ঞা লাবনী, খালেদ খান, গাজী রাকায়েতসহ আরও অনেকে। অন্যদিকে, জাহাজ ভাঙার কারিগর নিয়েও যে সিনেমা হতে পারে সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন শাহিন দিল রিয়াজ। ২০০৭ সালে 'লোহাখোর' শিরোনামে একটি সিনেমা বানিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। এখানে গরিব কৃষকদের গল্প বলা হয়েছে যারা উত্তরবঙ্গের খরার কারণে দক্ষিণবঙ্গ এসে জাহাজ ভাঙার কাজ খুঁজে নেয়। 'মনপুরা' ২০০৯ সালের সেরা ব্যবসাসফল সিনেমা। নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম এতে আবহমান গ্রামবাংলার প্রেমের গল্প দেখাতে চেয়েছেন। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলি। এটি ৩৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ পাঁচটি বিভাগে এবং ১২তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে দুটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। এয়ারপোর্টের রানওয়ের কাছে বসবাসরত এক গরিব পরিবারের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে 'রানওয়ে' সিনেমার কাহিনি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনও দেখানো হয়েছে ছবিতে। তারেক মাসুদ পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০১০ সালে। দেশীয় সিনেমার আরেকটি উলেস্নখযোগ সিনেমা 'আমার বন্ধু রাশেদ'। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে ১৯৭১ সালে মফস্বল শহরের কয়েকজন কিশোর কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তারই চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'টেলিভিশন', ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া কামার আহমেদ সিমনের 'শুনতে কি পাও', ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া রূবাইয়াত হোসেনের 'আন্ডার কনস্ট্রাকশন', ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া শবনম ফেরদৌসরি 'জন্মসাথী' দেশীয় চলচ্চিত্রকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। এসব চলচ্চিত্র দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও সম্মান বয়ে এনেছে। ২০১৮ সালে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের 'স্বপ্নজাল' মুক্তি পায়। নদীতীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা ইলিশ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্বপ্নজাল চলচ্চিত্রটির গল্প। এ ছবির সবচেয়ে বড় সফলতা বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা পরীমণিকে ভিন্ন আবেশে আবিষ্কার করা। ছবিতে শুভ্রার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমনি, আর অপু চরিত্রে ইয়াশ রোহান। সে বছর ছবিটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল। এদিকে অপরাধ থ্রিলারধর্মী চলচ্চিত্র 'আয়নাবাজি' মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ছবিটি মুক্তির পর পরই বক্স অফিস থেকে শুরু করে দর্শকের মন, সব জায়গায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বদলে ভাড়ায় জেল খাটা এক যুবকের গল্প দর্শক চোখ বন্ধ করে লুফে নিয়েছে। চলচ্চিত্রটি ৭টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। এছাড়া তৌকির আহমেদের 'অজ্ঞাতনামা', আবদুলস্নাহ মোহাম্মদ সাদের 'লাইভ ফ্রম ঢাকা', মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'ডুব', আকরাম খানের 'খাঁচা', রুবাইয়াত হোসেনের 'মেড ইন বাংলাদেশ', নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর 'আলফা', নুর ইমরান মিঠুর 'কমলা রকেট' ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ। তবে সিনেমাগুলোর গল্প, নির্মাণশৈলী ও পটভূমি দর্শকের হৃদয়ে আজীবনের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি পুরস্কারও বাগিয়ে এনেছে এসব চলচ্চিত্র। এছাড়া দর্শকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে 'খায়রুন সুন্দরী', 'মনপুরা' ও 'মনের মাঝে তুমি' সিনেমাগুলো।