শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
সিনিয়র শিল্পীদের অভিমত

গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না নতুন গান

মাসুদুর রহমান
  ২২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

প্রতি বছর অসংখ্য গান প্রকাশ হলেও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো গান আর এখন হচ্ছে না- এমন অভিযোগ কেবলমাত্র শ্রোতাদেরই নয়, অভিযোগ তুলেছেন সংগীতাঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় সংগীতশিল্পীরাও। গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পীর অভাব না থাকলেও অভাব রয়েছে মৌলিক গানের। নামকাওয়াস্তে অসংখ্য কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার আর ঘরে ঘরে গড়ে ওঠা স্টুডিওগুলোতে তৈরি হচ্ছে মানহীন গান। এই তালিকায় রয়েছেন কিছু গণমাধ্যমকর্মী বিনোদন সাংবাদিকও। তারা সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের গান পরিচিত শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানোর চেষ্টা করেন। অনেক সময় নিজেরাই কণ্ঠে গান তুলে নিয়ে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করেন। শুধু কি তাই! অনেক সময় এসব বিনোদন সাংবাদিক নিজে গান লিখে নিজেই সুর করে গান গেয়ে ইউটিউবে প্রকাশ করছেন।

অন্যদিকে ভাইরালের তকমা লেগে থাকা খাপছাড়া নতুন গানগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। মানহীন, প্রাণহীন এসব গান শ্রোতারা যেমন গ্রহণ করছেন না, তেমনি শিল্পীরাও নতুন গানে নির্ভরশীল হতে পারছেন না। নতুন গান নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা হলেও গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে বরাবরই। ঘুরেফিরে পুরনো গানগুলোই ফিরছে মুখে মুখে। যেকোনো প্রতিযোগিতা, কনসার্ট, লাইভ প্রোগ্রাম সব জায়গাতেই রয়েছে পুরনো গানের কদর। অনেক শিল্পী রয়েছেন, যাদের কোনো নতুন গান নেই। যে কারণে জনপ্রিয় তারকা শিল্পীদের গান দিয়ে আয় রোজগার করছেন। এক প্রকার বাধ্য হয়ে এখনকার শিল্পীরাও তাদের কণ্ঠে তুলে নিচ্ছেন পুরনো গান। যদিও এ সময়ের কণ্ঠশিল্পীরা দাবি করেন, এখনো ভালো গান হচ্ছে এবং সময়ের ব্যবধানে ২০-৩০ বছর পরে তাদের গানগুলোও কালজয়ী গানের তালিকায় জায়গা করে নিবে।

সৈয়দ আব্দুল হাদী বলেন, 'গান এখন সম্পূর্ণ বিনোদন হয়ে গেছে। গানের চেয়ে দেখাটাই যেন মুখ্য বিষয়। আমাদের সময় আমরা ভাবতাম গান কীভাবে শিল্পসম্মত করা যায়। এখন ভাবা হয় কীভাবে গান হিট করা যায়। ভালো কি মন্দ এর বিচার তো বর্তমানে করা যায় না। এখন স্থূলতার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক নেই।'

সিনিয়র কণ্ঠশিল্পী দিলরুবা খান বলেন, 'গানের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আফসোস হয়। মৌলিক গানের অভাব। এ সময়ের শিল্পীদের মধ্যে ভাইরাল-তারকা হওয়ার প্রবণতা কাজ করে। কিন্তু আমরা ভাইরাল হওয়ার পেছনে ছুটিনি। গানের পেছনে ছুটেছি। এখনকার শিল্পীদের সঙ্গে গীতিকার ও সুরকারের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। মৌলিক গানের অভাবে পুরনো গানকে নিজের মতো করে গেয়ে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সহজেই তারকা খ্যাতি পাওয়ার জন্য এমন পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। আমরা তা করিনি। আমার বাবা সৈয়দ হামিদুর রশিদ বেতারের শিল্পী ছিলেন। আমার দাদা এবং দাদার বাবাও গানের লোক ছিলেন। সংগীত পরিবারের মেয়ে হয়েও নিজেকে প্রচারের জন্য গান করিনি। অডিশনের মাধ্যমে রেডিও-টেলিভিশনে গাওয়ার সুযোগ পাই।'

কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে গীতিকবিদের যত্ন হচ্ছে না। যার ফলে এখনকার গানের ভাষায় আগের মতো দরদ থাকে না। এখন যেন প্রতিটি ঘরে ঘরে স্টুডিও। যিনি গীতিকার, তিনিই সুরকার এবং তিনিই গায়ক।'

ডলি সায়ন্তনী বলেন, 'এখন খুব কম গানই স্থায়িত্ব পাচ্ছে। আগের পরিবেশ এখন গানে নেই। ঘরে ঘরে স্টুডিও, জনে জনে শিল্পী। অনেকে এক গানেই ভাইরাল হচ্ছে। গানের প্রতি ভালোবাসা-সাধনাও কমে গেছে। এখন প্রায় জনেই নিজেকে প্রচারের জন্য ব্যস্ত থাকে।' এখন গান নিয়ে তেমন একটা ভাবা হচ্ছে না। খুব দ্রম্নত গান প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু আমরা গানের পিছনে সময় ব্যয় করেছি। গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীরা প্রতিনিয়ত গান নিয়ে বসেছি। গানের কথা ও সুর নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের পর শিল্পীর কণ্ঠে উঠতো। সবার প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর গান তৈরি হতো। সে জন্যই তখনকার গানগুলো এত জনপ্রিয় হয়ে কালজয়ী হয়ে আছে। সেইসব গানে মাদকতা ছিল। কথা, সুর মিলে শিল্পীর কণ্ঠে দারুণ শোভা পেত। সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে এসব গান গ্রহণযোগ্য। এখন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও আগের গান ব্যবহৃত হচ্ছে।'

রবি চৌধুরী বলেন, 'বর্তমান গানের স্থায়িত্ব কম। গানের কথায় ভালোমন্দ দুটো থাকলেও সুরের বেলায় কোনো বৈচিত্র্য নেই। মনে হয় ঘুরেফিরে একই সুরে গান শুনছি। কিন্তু আগের গানে তা ছিল না। গানের কথা, সুর ও শিল্পীর কণ্ঠ সব মিলিয়ে দারুণ লাগতো। তাইতো আগের গান কালজয়ী হয়ে আছে। কিন্তু এখন গান হচ্ছে অনেক তবে, গানের গভীরতা নেই। আজ শুনলে কাল ভুলে যাওয়ার মতো।'

মনির খান বলেন, 'সাধনা ছাড়া শিল্পী হওয়া যায় না। নতুনরা সাধনা তো দূরের কথা, ভালো করে গান না শিখেই স্টার হতে চায়। অনেক নতুনই মানহীন গানের মিউজিক ভিডিও করে নিজেদের প্রচারের চেষ্টা করছে। গান আসলে দেখার নয়, মূলত শোনার। কাগজের ফুল সৌরভ ছড়ায় না কিন্তু আলস্নাহর সৃষ্টি একটি ফুল চারিদিকে সুবাস ছড়ায়। অনেক নতুনরাই কাগজের ফুলের মতো বৃথা সুবাস ছড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। এজন্যই শ্রোতারা এখনকার গানে প্রাণ খুঁজে পান না। আগের মতো এখনকার গানে স্থায়িত্ব নেই।'

ন্যান্সি বলেন, 'গত কয়েক বছরে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে এমন কোনো গান হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। মৌলিক গানের অভাব। ফিউশন হচ্ছে অনেক। কখনো কখনো ফিউশনের নামে আসল গানের সৌন্দর্য নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে