গল্প ভালো না হলে অভিনয়ে ফিরব না :ববিতা

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
ববিতা
দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ববিতা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একমাত্র ববিতাই ছিলেন, যিনি সব ধরনের চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য সম্মাননা পাওয়া এ অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ধরেই অনুপস্থিত দেশীয় চলচ্চিত্রে। মাঝখানে শোনা গিয়েছিল চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়েছেন জীবন্ত এ কিংবদন্তি। পরে শোনা যায়, চলচ্চিত্রের পরিবেশে সুস্থতা ফিরলে এবং ভালো চিত্রনাট্য, পরিচালক কেন্দ্রীয় চরিত্র পেলেই কেবল অভিনয় করবেন তিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রের সুস্থ পরিবেশ এবং বাণিজ্যিক ছবির অবস্থা যেভাবে দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে, তাতে এ অভিনেত্রীর অভিনয়ে ফেরার বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। দেশীয় চলচ্চিত্রের এমন অবস্থায় দিন দিন যেমন সিনেমাহল কমে আসছে, তেমনি একের পর এক গুণী নির্মাতা ও কলাকুশলীরা হারিয়ে যাচ্ছেন চলচ্চিত্র থেকে। এর মধ্যে মহামারি করোনা এসে আরও বিপর্যস্ত করে দিয়েছে চলচ্চিত্রশিল্পকে। যদিও বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। তবে চলচ্চিত্রের দুরবস্থা কিছুতেই কাটছে না। খুলছে না বন্ধ সিনেমা হলও। সিনেমা মুক্তি দিতেও ভয় পাচ্ছেন নির্মাতারা। প্রশ্ন উঠেছে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাওয়া আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প আবার ঘুড়ে দাঁড়াবে কিনা? কীভাবে এ দুরবস্থার উত্তরণ ঘটানো যায়? কি ধরনের সিনেমা নির্মাণ করলে দর্শক হলমুখী হবে? চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরে আসবে? এসব প্রশ্ন নিয়ে খোলামেলা কথা হয় অভিনেত্রী ববিতার সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনার আগে থেকেই আমাদের চলচ্চিত্র ভালো অবস্থায় ছিল না। কিছু সিনেমা নির্মিত হলেও তা চলচ্চিত্র শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট মনে হয়নি। এর মধ্যেই করোনা এসে পুরো চলচ্চিত্রকে থামিয়ে দিয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্র যেহেতু আগে থেকেই দুর্দশাগ্রস্ত ছিল, করোনা এসে তা একেবারেই থমকে দিয়েছে। এ অবস্থা কাটতে সময় লাগবে। তবে চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে যে ধরনের সিনেমা নির্মাণ করা দরকার, তা একেবারেই হচ্ছে না। চলচ্চিত্রের অতীতের পরিবেশ টেনে ববিতা বলেন, আমাদের সময়ে দেখেছি, একের পর এক ভালো গল্পের সিনেমা হতো, এখন তা হচ্ছে না। এ সময়ের সিনেমার গল্পের গভীরতা বা স্থায়িত্ব কম। 'ওয়ান টাইম' গল্পের মতো। মনে রাখার মতো নয়। দেখলাম আর ভুলে গেলাম। আগে যেখানে একজন পরিচালক গল্প নিয়ে মাসের পর মাস মাথা খাটাতেন, এখন তা দেখা যায় না। এখন প্রযোজকরাই পরিচালককে গল্প বলে দেন। চার-পাঁচটি গান, ফাইট দিয়ে সিনেমার গল্প সাজানো হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন যেসব নির্মাতা সিনেমা নির্মাণ করেন, তাদের অনেকের কাছে সিনেমা হয়ে পড়েছে জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর। ফলে তারা প্রযোজকের ফরমায়েশ মতোই চলছে। কিছু নির্মাতা আছেন পুরস্কার পাওয়ার জন্য সিনেমা নির্মাণ করেন। এ ধরনের সিনেমার দর্শক আলাদা। সংখ্যায় খুব কম। এ সিনেমা দিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সচল করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি, আমাদের সময়ে জহির রায়হান, আমজাদ হোসেন, কাজী জহির, খান আতা, নারায়ণ ঘোষ মিতা, আলমগীর কবির, কামাল আহমেদের মতো প্রখ্যাত নির্মাতারা আপামর জনসাধারণের জন্য সিনেমা নির্মাণ করতেন। তাদের সিনেমা যেমন সব শ্রেণির দর্শক দেখতেন, তেমনি সেগুলো পুরস্কারও পেত। সিনেমা তো এমনই হওয়া উচিত। এখন সময় বদলেছে, প্রযুক্তি এবং মানুষের জীবন-যাপনেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এখন বিশ্বায়নের যুগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। এ সময়ের সাথে কি সে সময়ের তুলনা চলে? এমন প্রশ্ন করলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে ববিতা বলেন, ভালো গল্পের আবেদন তো চিরকালের। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, শেক্সপিয়রের গল্প-উপন্যাসের আবেদন কি এখন নেই? আমাদের যে সমাজ ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট, মূল্যবোধ ও শিল্প-সংস্কৃতি, তার মূল চরিত্র কি বদলে গেছে? আমরা কি অন্য কোনো সমাজে বসবাস করছি? প্রশ্নের উত্তরও নিজেই দেন ববিতা। বলেন, না, আমরা অন্য কোনো সমাজে বসবাস করছি না। আমরা হাজার বছর ধরে এই সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটেই বসবাস করছি। কাজেই, আমাদের সমাজ ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে যদি ভালো গল্পের সিনেমা নির্মাণ করা হয়, তবে তা দর্শক নিশ্চয়ই দেখবেন। আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মেলাব, তবে নিজের শিল্প-সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে নয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষ তো আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপনের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আমরা কি এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছি? পারছি না। বরং আমাদের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে অপসংস্কৃতিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। বলিউড কিংবা তাদের দক্ষিণের সিনেমা কিন্তু প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তাদের সংস্কৃতিই বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছে। আমরা তা করতে পারছি না। ববিতা বলেন, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সিনেমার গল্প এখন আর গল্পকার ও পরিচালকের সমন্বয়ে হয় না। গল্প হয়, প্রযোজকের নির্দেশনায়। তাহলে গল্পকার বা স্ক্রিপ্ট রাইটারের দরকার কি! এই যে যার কাজ তাকে করতে না দেওয়া, এ কারণে আমাদের চলচ্চিত্র ভালো সিনেমা পাচ্ছে না। একজন প্রযোজকের দায়িত্ব অর্থ লগ্নি করা। নির্মাতার দায়িত্ব প্রযোজকের লগ্নি রক্ষা হয়, এমন গল্পের সিনেমা নির্মাণ করা। এ কাজটি এখন নেই বলেই আমাদের সিনেমা দীর্ঘদিন ধরে দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। সিনেমার দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ববিতা বলেন, সিনেমা নির্মাণ করতে হবে সব শ্রেণির দর্শককে মাথায় রেখে। এটি হবে জনগণের। এই বৃহৎ পরিসরের চিন্তা নিয়ে সিনেমা বানাতে হবে। জহির রায়হান, আমজাদ হোসেন, কাজী জহিররা কিন্তু তাই করেছেন। তাদের চিন্তার প্রশস্ততা ও দূরদর্শিতা ছিল। ছিল বলেই এখনও তাদের সিনেমা মানুষ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে দেখেন। তাদের সিনেমা কালজয়ী হয়ে রয়েছে। এ ধরনের চিন্তা মাথায় নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করলে চলচ্চিত্রকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। মূল কথা হচ্ছে, দর্শককে ভালো গল্পের বাণিজ্যিক সিনেমা উপহার দিতে হবে। এ কাজটি করতে পারলে অবশ্যই আমাদের সিনেমা ঘুরে দাঁড়াবে।