বিদায় কবরী, চিরবিদায়

প্রকাশ | ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

জাহাঙ্গীর বিপস্নব
সারাহ বেগম কবরী; জন্ম :১৯ জুলাই ১৯৫০, মৃতু্য :১৭ এপ্রিল ২০২১
'নীল আকাশের নিচে', 'ময়নামতি', 'ঢেউয়ের পর ঢেউ', 'পরিচয়', 'অধিকার', 'বেঈমান', 'অবাক পৃথিবী', 'সোনালি আকাশ', 'অনির্বাণ', 'দীপ নেভে নাই'- এরকম অসংখ্য কালজয়ী সিনেমা আছে তার। যে সিনেমার মাধ্যমে দর্শকের মনের নির্ভীক কোণে নির্ভরযোগ্য স্থান করে নিয়েছেন তিনি। তার অনবদ্য ও সাবলীল অভিনয় দিয়ে একজন সাধারণ মিনা পাল থেকে হতে পেরেছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কবরী। নামটি শুনলেই সবার আগে আসে প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা সুভাষ দত্তের কথা। মৃতু্যর কিছুদিন আগে বরেণ্য চিত্রপরিচালক এ সাক্ষাৎকারে কবরীর বিষয়ে খোলামেলা কিছু কথা বলেছিলেন। তখন সুভাষ দত্ত কথা কম বললেও কবরীর প্রসঙ্গ উঠতেই নড়েচড়ে বসেন। মুখে যেন খই ফোটে তার। একের পর এক বলতে শুরু করেন নানা কথা। জানালেন, তখন ১৯৬৪ সাল। তার নতুন সিনেমার 'সুতরাং'-এর 'জরিনা' চরিত্রের জন্য একটি মেয়ে খুঁজছিলেন তিনি। এমন একটি মেয়ে, যিনি নায়িকা হবেন স্বয়ং সুভাষ দত্তেরই বিপরীতে। কথা ও শর্ত অনুযায়ী সন্ধান শুরু হলো মিষ্টি এক নায়িকার। অনেক সন্ধানের পর ছবির সংগীত পরিচালক সত্য সাহা কবরীর সন্ধান দিলেন সুভাষ দত্তকে। সত্য সাহা সে সময় সুভাষ দত্তকে বলেছিলেন, চট্টগ্রামে একটি মেয়ে আছে, নাম মীনা পাল। তার উচ্চতাও বেশি না। মঞ্চে কাজ করে। সুভাষ দত্ত এরপরই সত্য সাহাকে নিয়ে বিমানে চট্টগ্রামে গেলেন। চট্টগ্রামের ডা. কামালের সঙ্গে কবরীর বাবার পরিচয় ছিল। ডা. কামালকে নিয়েই কবরীদের বাড়িতে গেলেন সুভাষ দত্ত। অনেকটা সিনেমার মতো। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল কবরীকে। কবরীকে অডিশনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। কণ্ঠ ও সংলাপ পরীক্ষার পর দত্ত তাকে জরিনা চরিত্রের জন্য নির্বাচন করেন। এরপর দত্তের পরামর্শে চলচ্চিত্রটির লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার নাম পরিবর্তন করে 'কবরী' রাখেন। সেই যে শুরু। বহুল আলোচিত সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' সিনেমার মাধ্যমে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু হলো কবরীর। আর শুরুতেই দর্শকের কাছে পরিচিতি পান মিষ্টি মেয়ে হিসেবে। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের সেই 'মিষ্টি মেয়ে' আজ আর আমাদের মাঝে নেই। সর্বগ্রাসী করোনাভাইরাসের সঙ্গে প্রায় দু সপ্তাহ লড়াই করে শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দেন বাস্তবের বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ তোলা শক্তিমান নেত্রী ও অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। বিদায় নিলেন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে। তার এই চির বিদায়ের খবরে শোকে স্তব্ধ হয়ে ওঠে চারপাশ। গভীর রাতে অশ্রম্নতে ভিজে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কথা কিংবা কিছু লেখার মানসিকতা কিংবা ভাষা- দুটোই যেন হারিয়ে ফেলেন তার অনেক সহকর্মী, ভক্তকুল। ৭০ বছর বয়সি এ অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ধরে কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তার ফুসফুসেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়। গত ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাস 'পজিটিভ' আসার পর থেকে কবরী হাসপাতালে ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার বিকালে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। এরপর আর বেশি সময় পাননি তিনি। একদিন পরেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তিনি। করোনার কারণে বেশি বিলম্ব না করে শনিবার বাদ জোহরই রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয় তাকে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তাকে কবরস্থ করা হয়। দাফনের আগে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় 'গার্ড অব অনার' দেওয়া হয় কবরীকে। কবরীর সাফল্যের শুরুটা হয়েছিল প্রথম সিনেমা 'সুতরাং' দিয়েই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়েনি। 'ময়নামতি', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'সারেং বৌ', 'নীল আকাশের নীচে', 'সুজন সখী'র মতো সিনেমাগুলোয় দর্শকরা অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন বাংলাদেশের চিত্রজগতের অসামান্য এক তারকার তারকা হয়ে ওঠা। অভিনয়ে, প্রযোজনায়, পরিচালনায় তার সাত দশকের জীবনটা যেন আশ্চর্য সফলতার গল্প। তারপর সব ফেলে চলে যান না ফেরার দেশে। 'সুতরাং' (১৯৬৪) সিনেমার পর উর্দু ভাষার 'বাহানা' ও 'সোয়ে নদীয়া জাগে পানি' এবং লোককাহিনীনির্ভর 'সাত ভাই চম্পা' (১৯৬৮) সিনেমা দিয়ে ক্রমশ পরিচিত ও সফলতা অর্জন করেন। এরপর 'আবির্ভাব' (১৯৬৮) সিনেমার মাধ্যমে রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি গড়ে ওঠে তার। এই জুটির জনপ্রিয় ও সফল চলচ্চিত্রগুলো হলো 'ময়না মতি' (১৯৬৯), 'নীল আকাশের নিচে' (১৯৬৯), 'ক খ গ ঘ ঙ' (১৯৭০), 'দর্প চূর্ণ' (১৯৭০), 'কাঁচ কাটা হীরে' (১৯৭০), 'দীপ নেভে নাই' (১৯৭০),'স্মৃতিটুকু থাক' (১৯৭১) ও 'রংবাজ' (১৯৭৩)। তিনি 'লালন ফকির' (১৯৭২) সিনেমায় অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। সাহিত্যনির্ভর 'তিতাস একটি নদীর নাম' (১৯৭৩)-এর রাজার ঝি এবং 'সারেং বৌ' (১৯৭৮)-এর নবিতুন তার অন্যতম সমাদৃত দুটি কাজ। দ্বিতীয়োক্ত কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তিনি সুজন সখী (১৯৭৫) ও দুই জীবন (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আরও দুটি বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনা করেও সুনাম অর্জন করেছেন সারাহ বেগম কবরী। তার প্রথম পরিচালনার চলচ্চিত্র 'আয়না' মুক্তি পায় ২০০৮ সালে। এসিড নিক্ষেপের ঘটনার পর এক তরুণীর যাপিত জীবন নিয়ে নির্মিত হয় 'আয়না'। এ সিনেমায় নামভূমিকায় অভিনয় করেন সোহানা সাবা। এ সিনেমার মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় সোহানা সাবার। এতে সাবার বিপরীতে অভিনয় করেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। এরপর মাঝখানে লম্বা বিরতির পর 'আবার আসিব ফিরে' শিরোনামের একটি নাটক পরিচালনা করেন। সম্প্রতি সরকারি অনুদানের 'এই তুমি সেই তুমি' নামক একটি সিনেমার পরিচালনার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। সিনেমার শুটিং পর্ব শেষ হলেও বাকি কাজ শেষ করতে পারলেন না তিনি। তার আগেই সবাইকে গভীর শোকে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তিনি। বিদায় কবরী, বিদায়।