সত্তরে পা দিচ্ছেন শাবানা

প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২১, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
শাবানা
আফরোজা সুলতানা রত্না। বাবা-মায়ের দেওয়া ওই নামের মধ্যেও অনেক সৌন্দর্য ও মাধুর্য রয়েছে। কিন্তু পরিচালক এহেতেশাম কী ভেবে এমন সুন্দর নামটি শাবানা করলেন- তা এখনও অজানা সবার। পরবর্তীতে শাবানা নাম নিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন পরবর্তীকালের কিংবদন্তী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। 'জনগণ নন্দিত নায়িকা' হিসেবে খ্যাত এ তারকা পা দিচ্ছেন সত্তরে। ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালের আজকের দিনে (১৫ জুন) আজকের এই দিনটিতে বাবা ফয়েজ চৌধুরী ও মা ফজিলাতুন্নেছার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন ১১ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এ অভিনেত্রী। তবে প্রতিবারের মতো জন্মদিন ঘিরে এবারো কোনো আয়োজন রাখছেন না তিনি। শাবানার জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামে। খুব বেশি লেখাপড়া না করলেও অভিনয় নৈপুণ্যের জন্য শাবানাকে একজন জাত শিল্পীই মনে করা হয়। ১৯৬২ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে এহেতেশাম পরিচালিত 'নতুন সুর' সিনেমায় আবির্ভাব ঘটে তার। এই আবির্ভাবের পাঁচ বছর পর ১৯৬৭ সালে সেই সময়ের তারকা অভিনেতা নাদিমের বিপরীতে এহেতেশামের পরিচালনায় 'চকোরী' সিনেমায় একক নায়িকা হিসেবে অভিষেক ঘটে তার। এহেতেশাম ছিলেন শাবানার মামা। তার মায়ের খালাতো ভাই। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেন তিনি। এই ছবিটির মাধ্যমেই আফরোজা সুলতানা রত্না থেকে দর্শক মনে হয়ে যান চিরকালের শাবানা। সেই থেকে দীর্ঘ ৩৬ বছরের কর্মজীবনে ২৯৯টি সিনেমায় অত্যন্ত প্রতাপের সঙ্গে অভিনয় শেষে থামেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। এর মধ্যে ১৩০টি ছবিতেই তার বিপরীতে ছিলেন নায়ক আলমগীর। অভিনয়ে শাবানা রোমান্টিক ও ফোক-ফ্যান্টাসী দুই ধারাতেই সমান পারদর্শিতার পরিচয় দেন। ২০০০ সালে এসে বাংলা চলচ্চিত্রের রুপালি জগৎ থেকে হঠাৎ আড়াল হয়ে যান। তার সুনিপুণ অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ এই দীর্ঘ কর্মজীবনে রেকর্ড ১১ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া একবার প্রযোজক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে তিনি ১৯৮২-১৯৮৪ ও ১৯৮৯-১৯৯১ সালে দুইবার টানা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এগুলোর মধ্যে আমজাদ হোসেন পরিচালিত 'দুই পয়সার আলতা' (১৯৮২), সুভাষ দত্ত পরিচালিত 'নাজমা' (১৯৮৩), আমজাদ হোসেন পরিচালিত 'ভাত দে' (১৯৮৪) এবং 'রাঙা ভাবী' (১৯৮৯), 'মরণের পরে' (১৯৯০) ও 'অচেনা' (১৯৯১) ছবিগুলো উলেস্নখযোগ্য। এছাড়া বাচসাসসহ আরও অসংখ্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে একাধিকবার পুরস্কৃত হন শাবানা। ষাট থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত কোনো বিরতি ছাড়াই একটানা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন তিনি। সামান্য সময়ের জন্যও সমকালীন কোনো নায়িকাই তার অভিনয়ের ক্ষেত্রে হুমকি হতে পারেননি। দীর্ঘ কর্মজীবনের মূল্যায়ন হিসেবে ২০১৭ সালে তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। শাবানার সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র হচ্ছে, 'ঘরে ঘরে যুদ্ধ' (১৯৯৭)। এরপরই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে পাড়ি জমান। বর্তমানে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শাবানার আরও বহু দর্শকপ্রিয় ছবি রয়েছে। যেগুলো দেখার জন্য সিনেমাহলগুলোতে উপচেপড়া দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। ৭০ দশকের শুরুতে কাজী জহির পরিচালিত 'মধুমিলন' ও 'অবুঝ মন' দুটি চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের সাথে জুটি গড়ে তোলেন। দীর্ঘ সপ্তাহ জুড়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হওয়ার তালিকায় ছবি দুটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসেই একটা মাইলফলক হয়ে আছে। এছাড়া শোর লখনভী পরিচালিত উর্দু ছবি 'চান্দ সুরজ' এবং মোস্তাফিজ পরিচালিত 'একই অঙ্গে এত রূপ' ও কাজী মেসবাহউদদীন পরিচালিত 'ছদ্মবেশী' উলেস্নখযোগ্য। দেশ স্বাধীনের পর একই ধারাবাহিকতায় তার অভিনয় নৈপুণ্য বজায় রাখেন। ১৯৭৭ সালে সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া পরিচালিত 'জননী' ছবিতে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু তিনি এই পুরস্কার সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের সূচনা শাবানাই করেন। ১৯৭৯ সালে শাবানা স্বামী ওয়াহিদ সাদিককে নিয়ে এস এস প্রোডাকশন্স ব্যানারে প্রযোজকের খাতায় নাম লেখান। ১৯৭৩ সালে সরকারি কর্মকর্তা ওয়াহিদ সাদিককে বিয়ে করেন তিনি। শাবানা অভিনীত উলেস্নখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে আবদুলস্নাহ আল মামুন পরিচালিত 'সখি তুমি কার', আজিজুর রহমান পরিচালিত 'শেষ উত্তর' ও 'ছুটির ঘণ্টা', কামাল আহমেদ পরিচালিত 'রজনীগন্ধা', 'লালু ভুলু', শেখ নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'নতুন পৃথিবী', রাজ্জাক পরিচালিত 'চাপা ডাঙ্গার বউ', বুলবুল আহমেদ পরিচালিত 'রাজলক্ষ্ণী শ্রীকান্ত' এবং নিজ প্রোডাকশনের 'মাটির ঘর' (১৯৮৯), 'জীবনসাথী', 'দোস্ত দুশমন', 'পালাবি কোথায়', 'সমাধান' উলেস্নখযোগ্য। অভিনয় জীবনের শেষদিকে তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেও সুখ্যাতি অর্জন করেন। এর মধ্যে 'কন্যাদান' (১৯৯৫), 'সত্যের মৃতু্য নাই' (১৯৯৬), 'স্বামী কেন আসামী' (১৯৯৭) উলেস্নখযোগ্য। তার এই দীর্ঘ অভিনয় জীবনে যাদের সাথে জুটি বেঁধেছেন তাদের মধ্যে নাদিম, নায়ক রাজ রাজ্জাক, ওয়াসিম, ফারুক, আলমগীর, জসীম, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল, বুলবুল আহমেদ অন্যতম। তবে শাবানা যখন থেকে বাংলা চলচ্চিত্রকে বিদায় জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হন তখন থেকেই যেন বাংলা চলচ্চিত্রের দুরবস্থাও স্থায়ী হওয়া শুরু করল। তখন থেকেই যেন দর্শকও সিনেমাহল বিমুখ হওয়া শুরু করল। সিনেমা হলও একে একে উঠে যাওয়া শুরু হলো। বর্তমানে এ তারকা ধর্ম-কর্ম ও জনসেবা নিয়েই বেশি ব্যস্ত রয়েছেন। মাঝে মাঝে বাংলাদেশে এলে সংবাদকর্মীদের ভিড় জমে তাকে ঘিরে। বিনয়ের সঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, দয়া করে আমার ছবি তুলবেন না, আর পত্রিকাতেও আমার কোনো ছবি ব্যবহার করবেন না।' কিন্তু শাবানা বলে কথা!