সিনেমা থেকে হারিয়েই গেল কমেডি!

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২১, ১০:৩২

মাতিয়ার রাফায়েল
বাংলা সিনেমার কমেডি অভিনেতা আফজাল শরীফকেও দেখা যাচ্ছে না আর

শুধু শিক্ষণীয় বিষয়ই নয়, দর্শকের কাছে নাটক ও চলচ্চিত্র বিনোদনের দুটি বড় মাধ্যমও বটে। শিক্ষণীয় বিষয়ের সাথে বিনোদনটাও এমনই হবে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো যাতে হাস্যকর ও ধূলিস্যাৎ হয়ে না যায়। এমন নয় যে, পরস্পরবিরোধী হয়ে দুটো বিষয় সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। একদিকে সুন্দর কস্টিউমেরও পক্ষপাত থাকছে আবার অপ্রাসঙ্গিক নগ্নতারও প্রকাশ থাকছে। অথচ একটি পরিপূর্ণ সিনেমা হাসি-কান্না-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা মিলিয়েই হয়। শুধু নায়ক-নায়িকার টগবগে সংলাপ আর ফ্যান্টাসিই সব নয়। কিন্তু বর্তমান সিনেমায় গল্পের নানা অনুষঙ্গগুলো কাটছাঁট করতে করতে এমন এক জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে সিনেমায় কিছু চরিত্র আছে কিন্তু চরিত্রের পরিপূর্ণ চরিত্রায়ন নেই। চরিত্রগুলোর পরিপূর্ণতাও নেই। এভাবে কিছু চরিত্রই হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকাই সিনেমায় কমেডিয়ান বা কৌতুক অভিনেতার একটা গুরুত্ব ছিল। প্রাণোচ্ছল হাস্যরস বা কৌতুক অভিনেতা ছাড়া বাংলা সিনেমা কল্পনাই করা যেত না। সিনেমার নায়ক-নায়িকা, খল চরিত্রের পাশাপাশি বিনোদনের অপরিহার্য হিসেবে কৌতুক অভিনেতারাও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। কৌতুক অভিনয় শিল্পী শুধু বাংলাদেশেই নয়- সারা বিশ্বেই তার কদর রয়েছে। নির্বাক যুগের ব্রিটিশ অভিনেতা, হলিউড কাঁপানো স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র যিনি চার্লি চ্যাপলিন নামেই জগদ্বিখ্যাত; তার কৌতুক অভিনয় আজও মানুষের কাছে বিস্ময় হয়ে আছে। আরেক জগদ্বিখ্যাত ব্রিটিশ কৌতুক অভিনয় শিল্পী হচ্ছেন মি. বিন, সিটকম বস্নাকাডার, নট দ্য নাইফ ও'ক্লফ নিউজ খ্যাত রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন ওরফে রো। সিনেমা মানেই তাতে একটি পরিপূর্ণ সুন্দর গল্প থাকবে। সমাজের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রের সমাবেশ থাকবে। সেই চরিত্রের মাঝে এমন কিছু চরিত্র থাকবে যা গল্পের মূলভাবে থেকে গোটা সিনেমাটিকে আগলে রাখবে এবং টেনে নিয়ে যাবে। আমরা দেখি তাতে এমনই একটি চরিত্র যিনি পর্দায় উপস্থিত হওয়ার সঙ্গেই দর্শকের সব মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসেন। তার অভিনব বাচনভঙ্গি আর অভিনয় নৈপুণ্য বিশেষ বিনোদনের খোরাক হয়ে ওঠে। তারাই হচ্ছেন কমেডিয়ান বা কৌতুক অভিনেতা। কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমা থেকে এই কৌতুক অভিনেতারা যেন একেবারে হারিয়েই যেতে বসেছে। একজন বাংলাদেশি অভিনেত্রী বলেছিলেন, 'দেশের মানুষ যেন হাসতেই ভুলে গেছে।' তবে কি বাঙালি হাসতে ভুলে গেছে? যে হাসি ফোটানোর জন্য কৌতুক অভিনয় শিল্পীর কৌতুককর সংলাপ দর্শকের মন ভরিয়ে দিত নির্মল আনন্দে? অথচ ঢাকাই সিনেমায় নায়ক-নায়িকাই নয়, কৌতুক অভিনেতা ছাড়া গোটা সিনেমাটাই অসম্পন্ন হয়ে থাকত। বাংলাদেশে তেমনই বলিষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা ছিলেন খান জয়নুল। শুধু কৌতুক অভিনেতাই নয় তিনি পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবেও তার গুণের পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ ভ্রম্নভঙ্গির সঙ্গে কৌতুক অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শককে শুধু হাসাতেই নয়, কাঁদাতেও জানতেন তিনি। এছাড়া আরেকজন কমেডিয়ান রবিউল, যার শারীরিক উপস্থিতিতেই প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের মাঝে নির্মল হাসির ঢেউ খেলে যেত। বাঙালি জীবনাচারে কৌতুককর অনেক কিছুই আছে। গল্পেও তার অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু সে রকম সতেজ গল্পের অভাবে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে হাস্যরসাত্মক বিষয়গুলোও। তারই ধারাবাহিকতায় কমেডির গুরুত্বও কমে আসছিল দিন দিন। এখন তো সিনেমা থেকেই হারিয়ে যেতে বসেছেন এই শিল্পীরা। সর্বশেষ যাদের কমেডি দর্শককে মনোরঞ্জন করেছে তাদের মধ্যে বস্ন্যাক আনোয়ার, আফজাল শরীফ, ফাইয়াজ আহমদ ববি, কাবিলা, চিকন আলী, জ্যাকি আলমগীর, হারুন কিসিঞ্জার অন্যতম। কিন্তু সিনেমা থেকেই যদি কমেডির গুরুত্ব হারিয়ে যেতে বসে তখন এই শিল্প তারা কোথায় মেলে ধরবেন? শুধুমাত্র ম্যাগাজিনেই সীমাবদ্ধ থাকবে? অথচ সিনেমায় বা টিভি নাটকে বিপুল দর্শকের মনোরঞ্জন করে তাদের অনেকেই দর্শকপ্রিয় হয়েছেন। যেমন- বেবি জামান, সাইফুদ্দিন, আশীষ কুমার লৌহ, পরাণ বাবু, রবিউল, আনিসুর রহমান আনিস, হাবা আসমত, আলতাফ হোসেন, মতি, টেলি সামাদ, এটিএম শামসুজ্জামান, দিলদারদের নাম তো কিছুতেই হারিয়ে যাওয়ার নয়। তাদের অনেকের আবার নির্দিষ্ট দর্শকও ছিল। যাদের কমেডি দেখার জন্যই সিনেমাহলে দর্শক যেত। তাদের মধ্যে টেলি সামাদ, দিলদার, রবিউল, হাবা হাসমত, মতি, এটিএম শামসুজ্জামান অন্যতম। এখন তাদের শূন্যতা পূরণ না হওয়ায় ঢাকাই সিনেমার জৌলুসই হারিয়ে বসেছে অনেকটা। তারপরও যারা আছেন তারাও সিনেমায় ব্যবহৃত হচ্ছেন না। সেই দুঃখে অনেকে এই পেশাটাই ছেড়ে দিয়েছেন। তবে তাদের কারও কারও কৌতুক খুব বেশি ভাঁড়ামী হয়ে পড়ায় দর্শকই তাদের গ্রহণ করতে পারেনি। কৌতুক যে একটা আলাদা শিল্প, এটা যেন তারা ভুলেই যান। আর সাম্প্রতিক সিনেমায় যেন হাসতে না জানা দর্শকের জন্য হাস্যরসাত্মক গল্পবিহীন নায়ক আর খল নায়কের গুরুগম্ভীর অভিনয়ই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- 'ইন্ডাস্ট্রিটাই তো হারিয়ে যাচ্ছে। কৌতুক অভিনেতা নেইও আসলে। এটা হচ্ছে গড গিফটেড ব্যাপার। সবাইকে দিয়ে হয়ও না। যারা আছেন, সেই কাতুকুতু দিয়ে তো কমেডি হয়ও না। কাবিলা ছিলেন- গলার সমস্যায় পারছেন না। ভিলেনদের মধ্যে ছিলেন সাদেক বাচ্চু ভাই। আগে তো আমরা বাইরে থেকে যোগাড়যন্ত্র করে কমেডিয়ান আনতাম। এখন এটাও হচ্ছে না। মেইন হিরো-হিরোইনরাই কমেডি করছে। যেমন- শাকিব, ফেরদৌস- রিয়াজও করতেন। তবে দিলদার, খান জয়নুল, টেলি সামাদ, এটিএম শামসুজ্জামান, আলতাফ ভাইদের মতো কমেডিয়ান তো হবে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি সিনেমায় ভালো কমেডিয়ান যুক্ত করতে।'