শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

থমকে গেছে নৃত্যশিল্প

বিনোদন রিপোর্ট
  ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
নৃত্য পরিবেশন করছেন শিবলী মোহাম্মদ ও শামীম আরা নীপা

শিল্পকলার অন্যতম প্রাচীন একটি শাখা নৃত্যকলা। আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নন্দনতাত্ত্বিক, শৈল্পিক এবং নৈতিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে নৃত্যকলার সংজ্ঞা। নৃত্য বা নাচ শব্দটি সাধারণত শারীরিক নড়াচড়ার প্রকাশভঙ্গিকে বোঝায়। যুগ যুগ ধরে আমাদের চিত্তমনোরঞ্জনের অন্যতম এক বিনোদন এ নৃত্য এখন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু বিশ্ব কাঁপানো করোনা মহামারির ধাক্কায় থেমে গেছে দৃশ্যকাব্য রচয়িতাদের নূপুরের ঝংকার। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের এখন চরম দুর্দিন। সিনিয়র থেকে শুরু করে জুনিয়র নৃত্যশিল্পী, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢোল এবং বংশী বাদকদেরও বেকার করে দিয়েছে এই করোনা। দেশের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মঞ্চের নানা আয়োজন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ কেবলই বাড়ছে। এমনকি কেউ কেউ দীর্ঘদিনের চর্চিত এই পেশাকে বিদায় জানানোর জন্য মনস্থির করেছেন। এমনকি এরই মধ্যে অনেকেই নাচ ছেড়ে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। নৃত্যশিল্পী সংস্থার সূত্র মতে, দেশে প্রায় ১০ হাজারের বেশি রয়েছে নৃত্য সংগঠন। এছাড়া ২২৫টির বেশি নৃত্যস্কুলে নৃত্যচর্চার সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ২৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী; যারা করোনা থাবায় ধুঁকছেন। প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা কাটিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে শিল্পীরা যখন নতুন করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংস্কৃতির অন্য মাধ্যমগুলোর মতো নাচের জগতকেও ধাক্কা দেয়। নাচের চর্চা ও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজের অভাবে মানবেতর হয়ে পড়ে এই অঙ্গনের শিল্পীদের যাপিত জীবন। মানুষের জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলা শিল্পীদের জীবনটাই কাজের অভাবে এখন নিরানন্দে ভরা। এই শিল্পে জড়িতদের এখন চলছে চরম দুর্দিন।

এ বিষয়ে কথা হয় দেশের খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে। দেশের প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান বলেন, 'করোনায় নৃত্যাঙ্গনে আর্থিক সংকটটাই সবচেয়ে বেশি। যারা পেশাজীবী, তারা আর্থিকভাবে যেমন সংকটে পড়েছেন, তেমনি মানসিকভাবেও। অনেকে পেশাও বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা নাচ কিংবা গান ছাড়তে পারবেন না, কারণ এটা আত্মার খোরাক। তাই আয়ের জন্য বিকল্প উপায়ও খুঁজে বের করতে হচ্ছে। এমনও জানি, কেউ রেস্টুরেন্ট করছেন, কেউ করছেন ক্যাটারিং, অনলাইনে অনেকে কিছু করার চেষ্টা করছেন।'

নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক বলেন, 'এখন চরম দুর্দিন চলছে আমাদের নৃত্যশিল্পীদের। অথচ করোনা শুরুর আগেও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানের। কিন্তু করোনা সব ভেস্তে দিল। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের ৩০ জেলায় ১০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দিয়েছি।'

নৃত্য সংগঠন নৃত্যাঞ্চলের অন্যতম পরিচালক শিবলী মোহাম্মদ বলেন, 'বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় ও সুস্থ ধারার নাচে পৃষ্ঠপোষকতা এমনিতেই কমছে। তার ওপর করোনা এসে নৃত্যশিল্পীদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। আমার নিজেরই সংগঠনের শতাধিকের মতো নৃত্যশিল্পী বেকার হয়ে গেছে। যারা আমার চেয়ে ভালো নাচ করে এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা নিরূপায় হয়ে ঘরে বসে আছে। যাদের এই পেশার ওপর নির্ভর করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে আছে, তাদের কেউ কেউ অসুস্থ বাবা-মায়ের ওষুধ পর্যন্ত কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। তারা সরকার থেকেও কোনো প্রণোদনা পায়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আর নীপা তাদের সহযোগিতা দিয়েছি। এটা দিয়ে কতদিন চলবে?'

বাংলাদেশে নৃত্যশিল্পীদের মাঝে নিজের নৃত্য প্রতিভাকে যে ক'জন অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে শামীম আরা নীপা অন্যতম। তিনি বলেন, 'প্রায় দু'বছর ধরে মহামারির জন্য আমাদের নৃত্যশিল্পীদের অসুবিধার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে। সেটা আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত। আমি ঘরের বাইরে প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছি না। আমাদের নৃত্যাঞ্চলে যে সব নবীন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন তাদের অনেকেই এখন অনিয়মিত হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের নৃত্যশিল্প হুমকির মুখে পড়বে।'

আরেক সিনিয়র নৃতশিল্পী ডলি ইকবাল বলেন, 'নাচ মাধ্যমটি খুব ব্যয়বহুল একটা মাধ্যম। করোনার কারণে এখন নাচের আয়োজন হচ্ছে না। কিন্তু দেশের ২৬ থেকে ২৭টা চ্যানেলে নাটক তো হচ্ছে। তারা কি ঈদের কোনো আয়োজনে নাচ রাখতে পারতেন না? অন্তত ২০টা চ্যানেলে যদি ২০টি নাচের আয়োজন রাখত তাহলে ২০ জন নৃত্যশিল্পী উপার্জন করতে পারত না? অনেকে হতাশ হয়ে পড়ছে। এত অবহেলিত কেন আমরা?'

অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ বলেন, 'এখন আমি নিজেই বেকার হয়ে গেছি। আমার নাচের স্কুল বন্ধ, প্রোগ্রামসহ সবই বন্ধ। আমার সোর্স অব ইনকাম বলতে যেটা বোঝায় আমার জায়গা থেকে করতে পারছি না। সেই জায়গায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শুধুমাত্র নাচের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে। এমনকি যারা নাচের ড্রেস বানায়, ফুলের অর্নামেন্ট বানায়, ঘুংঘুর বানায় তারাও বেকার হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে ওরাও জড়িত। ওরা একেবারেই অসহায়। আমরা চেষ্টা করছি ওদের কাউকে কাউকে সহযোগিতা করার। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ।'

নৃত্যশিল্পী মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান সাকিব বলেন, এখন আমাদের জীবন বড্ড সংকটময়। সীমাহীন মনোকষ্টে আছি। তারপরও কারও কাছে কিছু চাইতে পারি না লজ্জায়।'

এমন পরিস্থিতিতে আগামী দিনও যে খুব কঠিন, তা নিয়ে নৃত্যশিল্পীদের কোনো সন্দেহ নেই। সবকিছু স্বাভাবিক না হলে এই শিল্পীদের পক্ষে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন। তবুও এই পরিস্থিতিতে নৃত্যশিল্পীরা আশা করছেন, খুব শিগগিরই দিন ফিরবে, দেশ-বিদেশের মঞ্চে আবারও বেজে উঠবে নূপুরের নিক্বণ। ক্লাসরুমগুলো মুখর হবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে