নাটক গান চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু

প্রকাশ | ১৭ মার্চ ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২২, ০৯:২২

ম মাতিয়ার রাফায়েল

গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যতটা উজ্জ্বল ও স্বমহিমায় প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে, বিগত ৪৭ বছরে কোনো সময়ই এভাবে প্রতিফলিত হয়নি। যদিও জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের আগেই 'বঙ্গ-বন্ধু' নামের সিনেমা বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন অভিনেতা রাজ। সেই খবর ওই সময়ের পত্রিকায় প্রকাশ হয়, শিরোনাম 'নতুন ছবি বঙ্গ-বন্ধু'। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত সেটাই ছিল প্রথম উদ্যোগ, এরপর গঙ্গার জল পদ্মায় অনেক গড়িয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো সিনেমা হয়নি। সংস্কৃতিবান্ধব বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই তার পটপরিবর্তন হয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বাধীনতার আগে এবং পরে এমনকি তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লেখা হয়েছে অজস্র কবিতা, গান ও নাটক। পৃথিবীর অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে এত বিপুলসংখ্যক শিল্প সৃজনের ইতিহাস নেই। বিশেষ করে, দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই চিত্রটি সবচেয়ে বেশি ভাস্বর হয়ে আছে। তবে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, অ্যানিমিশন চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি, পেইন্টিং, স্কেচ, নাটকে ও গানে এটার প্রকাশ যতটা মজবুত হয়, অন্য কোনো মাধ্যমে ততোটা নয়। সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নিজেরও চলচ্চিত্র শিল্পসহ, শিল্পের সব শাখার প্রতিই উৎসাহ ছিল। রাজনীতি নিয়ে সর্বদা ব্যস্ততার মধ্যেও পারিবারিকভাবে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখেছেন- এমন নজীরও আছে। পুরান ঢাকার 'মায়া' নামে একটি প্রেক্ষাগৃহে উত্তম-সূচিত্রা অভিনীত 'শাপমোচন' সিনেমা দেখেছেন। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'সংগ্রাম' সিনেমায় নিজের ভূমিকায় ক্যামিও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক সবাইকেই সমভাবে কদর করতেন। আর্থিক অনটনে গুরুত্বপূর্ণ চাকরির ব্যবস্থাও করে দিতেন। শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক-সংস্কৃতির এসব শাখার প্রতি ভালোবাসা ছিল বলেই বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই আজকে এফডিসিও প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই মন্ত্রিসভার শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। সে সময় ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন এ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র 'মুখ ও মুখোশ' এর নির্মাতা আবদুল জব্বার খান, পূর্ববাংলার পরিসংখ্যান বু্যরোর পরিচালক ডক্টর আবদুস সাদেক, নুরুজ্জামানসহ অনেকে। তিনি তাদের ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পেশ করতে বলেন। সেই সূত্রে আবদুল জব্বার খান ও তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দীন যৌথভাবে সরকারের কাছে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। পরে সেই প্রস্তাবেরই বাস্তবরূপ আজকের এফডিসি। সে জন্য বর্তমান সরকারও বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দেয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রতিই বেশি। এ লক্ষ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদানের অংকও অনেক বাড়ানো হয়েছে। এর সুফল এখন হাতেনাতেই ভোগ করছে সরকারি অনুদানের পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো। এর মধ্যে মুক্তি পাওয়া, মুক্তির অপেক্ষায় থাকা এবং নির্মাণাধীন ও প্রস্তাবনায় থাকা সিনেমা মিলিয়ে প্রায় শ' পঞ্চাশেক হয়ে গেছে। যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন নতুন সিনেমা হচ্ছে, এতে করে এটা ভবিষ্যতে কোনো একক নেতাকে নিয়ে সিনেমা করার ক্ষেত্রে গিনেস রেকর্ড বুকেও উঠতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে 'টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই' চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে বলেন, 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যেকোনো একটি দিন নিয়েও চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব।' প্রিমিয়ার শো'তে দীপু মনি আরও বলেন, 'এই চলচ্চিত্রটি বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কাল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র এই প্রথম মুক্তি পেল। আশা করি, তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের যাত্রা অব্যাহত থাকবে।' ইতোমধ্যে মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সেলিম খানের 'টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই', নজরুল ইসলামের 'চিরঞ্জীব মুজিব', অ্যানিমিশন চলচ্চিত্র ডক্টর হানিফ সিদ্দিকীর 'খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা', মোহাম্মদ সোহেল রানার 'মুজিব আমার পিতা', তৌকির আহমেদের 'স্ফূলিঙ্গ' দর্শকের ব্যাপক প্রশংসাও কুড়িয়েছে। মুক্তির অপেক্ষায় আছে বহুল আলোচিত শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক 'বঙ্গবন্ধু', আশরাফ শিশিরের '৫৭০'।। নির্মাণাধীন আছে কাজী হায়াত পরিচালিত 'জয়বাংলা', মুশফিকুর রহমান গুলজারের 'টুঙ্গিপাড়ার দুঃসাহসী খোকা', এফএম শাহীন ও হাসান জাফরুল (বিপুল) পরিচালিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র 'মাইক'। আছে পরিকল্পনায় থাকা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরও সিনেমা। উত্তম আকাশের 'বাবা তুমি কেমন আছো' ছাড়াও আছে আরও ১২টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা। শুধু চলচ্চিত্রই নয়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মঞ্চনাটক, টিভি নাটকও হচ্ছে এখন অবারিতভাবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে টিভি নাটকের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- মান্নান হীরার 'মহামানবের দেশে', আরটিভির 'মহানায়ক', সহিদ রহমান রচিত আবুল হায়াত পরিচালিত 'তখন পঁচাত্তর', একাত্তর টিভি'র '৩২ এর ক্রন্দন' অন্যতম। তবে তুলনামূলকভাবে টিভিতেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কম নাটক হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিতে হতে দেখা গেছে মঞ্চ ও যাত্রাপালাতেই বেশি। ২০২১ সালে 'নবনাট্যে নব নন্দনে বঙ্গবন্ধু' শিরোনামে ৬৪টি জেলায় হয়েছে মঞ্চনাটক। এ ছাড়া এর আগে আবদুল গাফ্‌ফার খান চৌধুরীর 'পলাশী থেকে ধানমন্ডি' লন্ডন, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেন পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটকও পড়ানো হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেমন, কেনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিসুর রহমানের 'আমি শেখ মুজিব', 'দাবিত ইসাক', 'মন্ত্রী ও হায়েনা' নাটক পড়ানো হচ্ছে। 'আমি শেখ মুজিব' নাটকটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন নাট্যমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটক শামীম সাগরের 'আমার সাধ না মিটিল' এবং লোক নাট্যদলের লিয়াকত আলী লাকী নির্দেশিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও সমাপ্ত স্বাধীনতা'। এ ছাড়া লিয়াকত আলী লাকীর 'মুজিব মানেই মুক্তি', মামুনুর রশীদের 'টার্গেট পস্নাটুন' ও 'সোয়াত', মাসুম রেজার 'জনকের অনন্তযাত্রা', মান্নান হীরার 'আগুনের ছায়া', দেবাশীষ ঘোষের 'প্রহরী', রুমা মোদকের 'যুদ্ধ ও জয়িতারা', মুন্সি মোহাম্মদ আলি রুমির 'বিজয়ের প্রান্তে', 'আকবর রেজার 'মেঘের স্বীকৃতি', মাহমুদুল ইসলাম সেলিমের 'মুখোমুখি', ডক্টর পরিমল সরকারের 'বন্ধু নঈমকে খোলা চিঠি', আনন জামানের 'বালিকা ও একটি স্বর্ণপশম ভেড়ার নাট্য', শামীম সাগরের 'সিংহজানির দুঃখগাথা কিংবা পুনর্জাগরণ পালা', 'হাসান তারেকের 'শিরোমণির ট্যাংকযুদ্ধ, অতঃপর', মাহবুব লীলেনের 'মুক্তিকথন', টিটো রেদওয়ানের 'আঁ লে হঁ দিশম লে স্বাধীনাকাদা', কামাল উদ্দিনের 'শনি', আল জাবিরের 'মুক্তির প্রতিভাস', শামসুল হাদীর 'সবুজ রক্ত ও এন্টিভাইরাস'। অন্যতম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হয়েছে বহু যাত্রাপালা। এর মধ্যে রয়েছে- মন্মথ রায়ের 'আমি মুজিব নই', দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দুরন্ত পদ্মা', উৎপল দত্তের 'জয়বাংলা', নরেশ চক্রবর্তীর 'সংগ্রামী মুজিব', নিরাপদ মন্ডলের 'মুক্তিফৌজ', সত্যপ্রকাশ দত্তের 'বঙ্গবন্ধু মুজিবুর', ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গবন্ধুর ডাক', অরুণ রায়ের 'আমি মুজিব বলছি', ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র 'মুজিবের ডাক', সাধন চক্রবর্তীর 'শেখ মুজিব', মৃণাল করের 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব', পরিতোষ ব্রহ্মচারীর 'নদীর নাম মধুমতি' এবং কবিয়াল বিপিন সরকারের 'মুক্তিসেনা' প্রভৃতি। তবে এই যাত্রাপালাগুলোর সবই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্বে অভিনীত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকেই এ দেশের যাত্রাপালায় দুর্দিন চলে আসে। ২০ বছর আর নতুন পালা হয়নি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ বছর পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটপরিবর্তন হলে দিলীপ সরকার রচনা করেন 'বাংলার বিজয়' নামের যাত্রাপালা। যাত্রাসম্রাজ্ঞী জ্যোৎস্না বিশ্বাস ১৯৯৬ রচনা করেন 'রক্তস্নাত একাত্তর' নামের যাত্রাপালা। পালাটি ঢাকার মঞ্চে ১৭ বার অভিনীত হয়। একই বছর আব্দুস সামাদ নামের এক পালাকার 'একাত্তরের জলস্নাদ' নামের পালা রচনা করেন। ১৯৯৫ সালে এমএ মজিদ রচিত 'সোনার বাংলা' এবং ১৯৯৭ সালে নজরুল ইসলাম সাজু রচিত 'বাংলার মুক্তি' পালা দুটিও বিষয়ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু। এ ছাড়া 'সোনার বাংলা', 'বাংলার বিজয়', 'বাংলার মুক্তি' যাত্রামঞ্চে অভিনীত হয়।