বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে মিষ্টি প্রেমের সিনেমা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ২৯ জুন ২০২২, ০০:০০
'ভালোবাসার রং' সিনেমায় বাপ্পী চৌধুরী ও মাহিয়া মাহী

ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এখন মিষ্টি প্রেমের সিনেমার অভাবে যেন নিজেই নিজেকে হারিয়ে খুঁজছে। অথচ এক সময়ে এই ধরনের সিনেমাই ছিল ইন্ডাস্ট্রির মূল প্রাণ। দেশে যে কয়টি জনপ্রিয় জুটি হয়েছে মিষ্টি প্রেমের সিনেমা দিয়েই। কোনোটি লোকগল্পের, কোনোটি মৌলিক গল্পের। গোটা সত্তর দশকই গেছে মিষ্টি প্রেমের সিনেমায়। আশি ও নব্বইয়েও হয়েছে; তবে এ সময় থেকেই এ ধরনের সিনেমা হ্রাস পেতে থাকে এবং ধরনও বদলে যেতে থাকে।

কাজী জহির হলেন ঢাকাই সিনেমায় নিটোল মিষ্টি প্রেমের ভিত গড়ে দেওয়ার পথিকৃৎ। এ জন্য তাকে মিষ্টি প্রেমের সিনেমার অলিখিত সম্রাটও বলা যায়। একাই যত ব্যবসাসফল সিনেমা বানিয়েছেন তার ধারেকাছেও নেই কেউ। কাজী জহিরের নাম পাঁচ অক্ষরের; সিনেমার নামও দিয়েছেন পাঁচ অক্ষরের। 'অবুঝ মন', 'ময়না মতি', 'বধূ বিদায়', 'কথা দিলাম', 'মধু মিলন', 'নয়ন তারা', 'ফুলের মালা'- এরকম কালজয়ী মিষ্টি প্রেমের সিনেমাই শুধু নয় বাণিজ্যসফল নির্মাতাও তিনি। অবশ্য তার নামের পাঁচ অক্ষরের বাইরের ১৯৬২ সালে প্রথম উর্দু সিনেমা 'বন্ধন' এবং ১৯৬৬ সালের 'ভাইয়া' সিনেমা দুটিই ব্যাতিক্রম। তাতেও ছিল মিষ্টি প্রেম। নির্মাতা হিসেবেই নয়, কাজী জহির একাধারে প্রযোজক, চলচ্চিত্র পরিবেশক এবং হল মালিকও ছিলেন। তার হাত ধরেই খ্যাতি পায় রাজ্জাক-কবরী জুটি। সিনেমার সোনালি যুগে কাজী জহিরকে বলা হতো রোমান্টিক পরিচালক। মিষ্টি প্রেমের সিনেমার পরিচালক হতে রোমান্টিক মিষ্টি মনও লাগে। লোককাহিনীর মিষ্টি প্রেমের বাইরে রোমান্টিক মৌলিক গল্পের সিনেমা নির্মাণে কাজী জহিরের তুলনা কাজী জহিরই। যার সিনেমা মানেই রোমান্সে ভরপুর আর নতুনত্ব। 'অবুঝ মন' ছিল সেই সময়ে পৃথক দুটি ধর্মের বন্ধুত্ব, ত্যাগ ও মানবিকতার অসাধারণ এক গল্প নিয়ে করা সাহসী সিনেমা। এ যেন নিজ বিবাহিত জীবনকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। চিত্র সিনহা ছিলেন সে সময়ে কলকাতায় আলোচিত অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী। এহতেশাম পরিচালিত 'রাজধানীর বুকে' সিনেমার নায়িকা হয়ে পদার্পণ করেন ঢাকায়। এরপর কাজী জহিরের 'বন্ধন' সিনেমায় যুক্ত হওয়ার পর প্রেম ও বিয়ে। নিজ জীবনটারই যেন ভিন্ন আঙ্গিক 'অবুঝ মন'। গুণী এই নির্মাতার উচ্চতর শিক্ষা ছিল সবচেয়ে নিরস ও কাঠখোট্টা বিভাগ অর্থনীতির। ছিলেন নটরডেম কলেজের শিক্ষক। এমন কাঠখোট্টা নিরস বিষয়ের শিক্ষক হয়েও কী করে এতগুলো মিষ্টি প্রেমের সিনেমা বানিয়েছিলেন এটা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছেও বিস্ময়।

প্রথম মিষ্টি প্রেমের হিসেবে এহতেশামের 'রাজধানীর বুকে' সিনেমাটিকেই ধরতে হয়। সিনেমার 'তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে' গানটি সে সময়ে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। শুধু তাই নয়, বাংলা চলচ্চিত্রে রোমান্টিক গানের মধ্যেও এটি অন্যতম সেরা একটি গান। সে বছরেই ফতেহ লোহানী করেন 'আসিয়া' (সিনেমাটি পরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার এবং পরে নিগার পুরস্কার লাভ করে) নামের আরেকটি মিষ্টি প্রেমের সিনেমা। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন সুমিতা দেবী। এরপর থেকেই সত্তর দশক জুড়ে মিষ্টি প্রেমের সিনেমা চলতে থাকে। কাজী জহিরের পর যার নাম আসে তিনি 'সুজন সখী'র প্রমোদ কর। এছাড়া আবদুল জব্বার খান, সালাহউদ্দিন, মুস্তাফিজ, মহিউদ্দিন, সুভাষ দত্ত, এস এম শফি, খান আতাউর রহমান, কামাল আহমেদ, সফদার আলী ভূঁইয়া, অশোক ঘোষ, নারায়ণ ঘোষ মিতা, শিবলী সাদিক, আওলাদ হোসেন, আজিজুর রহমান, রহিম নেওয়াজ, জহির চৌধুরী, মোস্তফা মেহমুদ, আলমগীর কবির, রুহুল আমীন, রফিকুল বারী চৌধুরী, আমজাদ হোসেনসহ আরও অনেকে মিষ্টি প্রেমের সিনেমা বানিয়ে খ্যাত হয়েছেন।

তাদের সবাই কাজী জহির বা প্রমোদ করের মতো শতভাগ নিটোল মিষ্টি প্রেমের সিনেমা না করলেও তাদের অনেকের সিনেমাতেই মিষ্টি প্রেমের আবহ ছিল। রোমান্সধর্মী এ সিনেমাগুলোর যেসব দর্শকের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে- রুহুল আমীনের 'বেঈমান', মোস্তফা মেহমুদের 'অবাক পৃথিবী', 'মনিহার', রহিম নেওয়াজের 'সুয়োরানী দুয়োরানী', আজিজ আজহারের 'চোখের জল', এস এম শফির 'দি রেইন', রফিকুল বারী চৌধুরীর 'ভুল যখন ভাঙলো', বাবুল চৌধুরীর 'চাষীর মেয়ে', মাসুদ পারভেজের 'এপার ওপার', ফাল্গুনী গোষ্ঠির 'মলুয়া', প্রমোদ করের 'দিন যায় কথা থাকে', নাজমুল হুদা মিন্টুর 'ডাক পিওন',

সফদর আলী ভূঁইয়ার 'কাজল রেখা', আলমগীর কবিরের 'সূর্য কন্যা', জহিরুল হকের 'প্রাণসজনী', মুশতাকের 'বন্দিনী', আমজাদ হোসেনের 'নয়ন মনি', আজিজুর রহমানের 'অমরপ্রেম', রাজ্জাকের 'অনন্ত প্রেম', অশোক ঘোষের 'নাচের পুতুল', আব্দুল লতিফ বাচ্চুর রাজ্জাক-সুচরিতা অভিনীত 'যাদুর বাঁশি', নারায়ণ ঘোষ মিতার 'নীল আকাশের নীচে', আবদুলস্নাহ আল মামুনের 'সারেং বৌ', আজিজুর রহমান বুলির 'শেষ উত্তর', ফখরুল হাসান বৈরাগীর 'বিনি সুতার মালা', তোজাম্মেল হক বকুলের 'বেদের মেয়ে জোসনা', চাষী নজরুল ইসলামের 'দেবদাস', হাফিজ উদ্দিনের 'পথে হলো দেখা', দিলীপ সোমের 'মহা মিলন', কামাল আহমেদের 'ব্যথার দান', মোস্তফা আনোয়ারের 'কাশেম মালার প্রেম', সালাউদ্দিন কবিরের 'আয়না বিবির পালা', শিবলি সাদিকের 'অন্তরে অন্তরে', বাসু চ্যাটার্জির 'হঠাৎ বৃষ্টি', ছটকু আহমেদের 'বুক ভরা ভালোবাসা', জাকির হোসেন রাজুর 'এ জীবন তোমার আমার', শাহীন সুমনের 'ভালোবাসার রং' শিহাব শাহীনের 'ছুঁয়ে দিলে মন' প্রভৃতি।

মিষ্টি হাসির কবরী ও রাজ্জাককেই বেশি মিষ্টি প্রেমের সিনেমায় দেখা যায়। এতেও বোঝা যায় রাজ্জাক এবং কবরী কেন এতো জনপ্রিয়। আরও অনেকে মিষ্টি প্রেমের সিনেমা করে জনপ্রিয় হয়েছেন। রহমান, ফারুক, সুচন্দা, শবনম, শাবানা, ববিতা, সালমান শাহ, ফেরদৌস আহমেদ প্রমুখ। এক্ষেত্রে রাজ্জাকের পরেই আছেন সালমান শাহ তারপরে ফেরদৌস আহমেদ। সালমান শাহের মৃতু্যর পর থেকেই মূলত মিষ্টি প্রেমের সিনেমা হ্রাস পেতে থাকে। মিষ্টি প্রেমের সিনেমায় পারফর্ম করতে সে রকম মিষ্টি লুকের নায়ক-নায়িকাও হতে হয়।

প্রকৃত মিষ্টি প্রেমের সিনেমা মূলত নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকেই কমতে থাকে। এখন এ ধরনের সিনেমা খুবই কম হয়। এ প্রসঙ্গে আক্ষেপ করে ফেরদৌস আহমেদ বলেন, 'এখনকার সিনেমাতে কেমন যেন পাঁচমিশালী ব্যাপার এসে গেছে। এই প্রেম এই দ্রোহ, এই অস্থিরতা- কী যেন বলতে চায় সিনেমাগুলোতে- কিন্তু কিছুই বলতে পারে না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে