আমজাদ হোসেনের স্মৃতিকথা

একাধারে তিনি ছিলেন গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী এবং লেখক। মাঝে মাঝেই তার লেখা ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে একটি লেখাÑ

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পকর্ গড়ে উঠেছে। খেলাধুলায় কখনো ভালো ছিলাম না বলে ফুল, পাখি, প্রজাপতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আকাশে মেঘ জমলে আমার মন খারাপ হয়ে যেত। ঝকমকে রোদের দিন আনন্দের সীমা থাকত না। দিনভর ছোটাছুটি করতাম। এমনকি সন্ধ্যাবেলায় খোলা মাঠে অথবা আমাদের উঠোনে, পূণির্মার চঁাদের সঙ্গে দৌড়াতাম। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। ঘামে ভিজে যেত শরীর। দীঘর্পথ দৌড়াদৌড়ি করে হাঁপাতে হাঁপাতে যেকোনো জায়গায় যখন দাঁড়িয়ে পড়তাম, তখনো দেখতাম যেখানকার চঁাদ সেখানেই আছে। অথচ দৌড়ানোর সময় মনে হতো চঁাদটাও আমার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। আমি যেখানেই যাই, যত দূরেই যাই। আকাশের চঁাদটাও ঠিক একই জায়গাতেই থাকে। শুধু চঁাদ কেন, পাড় ধরে ধরে নদীর সঙ্গেও দৌড়াদৌড়ি করেছি। এই ব্রহ্মপুত্র নদের মতো যেন আমিও অনেক দূরে যাবÑ এ রকম একটা ইচ্ছা নিয়েই দৌড়াদৌড়ি করেছি নদীর সঙ্গে। ছুটি রেলগাড়ির সঙ্গেও দৌড় দিয়েছি। তেপান্তরের সবুজ ধানখেত ভেঙে ভেঙে, যতটুকু শক্তিতে কুলোয়, দম বন্ধ করে দৌড় দিতাম। ধানগাছের ধারালো পাতায় পা ছড়ে গেছে। হাঁটুর ছাল উঠে গেছে। রক্ত বেরিয়েছে। এসব লুকোতে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় মায়ের কাছে ধরা পড়েছি, চড়থাপ্পড় খেয়েছি। পরের দিন আবার মায়ের শাসন ভুলে গিয়ে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছি। আমি যেন অনেক দূরে যাব। আমাকে যেতেই হবে। কবে, কখন এমন একটা ভাবনা আমার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, আমি তা জানি না। আজও বলতে পারি না। আমার ছেলেবেলাটা ছিল এ রকম। দৌড়াদৌড়ি। ছোটাছুটি। প্রতি সন্ধ্যায় আকাশের নক্ষত্র গোনা। কোন পাখির কী ডাক। কোন ফুলের কী রকম গন্ধ। এমনকি মা একদিন শবেবরাতের সন্ধ্যায় বলেছিল, আজ এই পৃথিবীর সবাই নামাজ পড়বে। বন-বিরিক্ষির লতাপাতাও এই রাতে আল্লাহ তায়ালাকে সেজদা করবে। প্রথম রাতে বাবা-কাকার সঙ্গে দু-চার রাকাত নামাজ পড়ে খাওয়াদাওয়া করে দাদির দোতলা টিনের ঘরে গিয়ে লুকিয়েছিলাম। দোতলা থেকে বাড়ির আম-কঁাঠালের গাছগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। মনে মনে প্রতীক্ষা করেছি, আজ রাতে ঘুমাব না। গাছগুলো কীভাবে সেজদা করবে, আমি তা দেখব। গভীর রাতে ঘুমে ঢলে পড়ছিলাম। গা ঝাড়া দিয়ে ঘুম তাড়ালাম। তাকিয়ে রইলাম গাছগুলোর দিকে। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল। রোদ উঠল। কিন্তু কোনো গাছকে তো সেজদা করতে দেখলাম না। পরে অবশ্য মা বলেছিল, যারা ইমানদার, তারাই শুধু দেখতে পায়।