শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টিভি নাটকে গুরুত্ব হারাচ্ছেন মঞ্চশিল্পীরা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০

চলচ্চিত্রের মতো বিটিভির নাটকের দীনতা নিয়েও নানা কথা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। কেন বিটিভির বর্তমান এই দীনতা- এ নিয়ে নানামুখী বক্তব্য দিচ্ছেন টিভি নাটক সংশ্লিষ্টরা। তাতেও এই দৈন্যদশার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। অগ্রসর হতে পারছে না সরকারি-বেসরকারি টিভি। তাহলে গলদটি কোথায়? সেই যে ১৯৬৪ সালে যাত্রা করা বিটিভিতে (শুরুতে 'পিটিভি' এবং পরবর্তীতে ঢাকা টিভি) বরেণ্য সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচিত এবং আনোয়ার উদ্দিন খানের সুর করা 'ওই যে আকাশ নীল হলো আজ/ সে শুধু তোমার প্রেমে/ ওই যে বাতাস বাঁশি হলো আজ,/ সে শুধু আমার প্রেমে...' গান দিয়ে শুরু করে আর থামতে হয়নি। নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে দর্শকের বিনোদনের চাহিদা মিটিয়ে আসছিল। গানের পর নৃত্যনাট্য 'উদয়াচলের পথে' পারফর্ম করেছিলেন জিনাত আলী পলি (পরবর্তীতে জিনাত বরকত উলস্নাহ)।

বিটিভি যখন একেবারে আনকোরা তখনও প্রতিষ্ঠানটিকে ভুঁইফোঁড় নির্দেশক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও গানের শিল্পীদের নিয়ে যাত্রা করতে হয়নি। উলিস্নখিত গান ও নাচের দুই মহিরুহ দুই শিল্পীর নামেই বোঝা যায়। ছিল আজকের মহিরুহ ছায়ানটও। দেশের শিল্প-সংস্কৃতি এতটাই গভীরে প্রোথিত ছিল যে, বিটিভির প্রতিষ্ঠাই ছিল সময়ের দাবি। আর প্রতিষ্ঠিত হয়েই এই চ্যানেলটি সেই দাবি ও চাহিদাও মেটাতে পারে আগে থেকেই বিভিন্ন মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী-কলাকুশলীরা থাকাতেই। সেই ষাট দশক থেকে যাত্রা করা বিটিভি দর্শকের বিনোদনের চাহিদা মিটিয়েছে গোটা নব্বই দশক পর্যন্ত বেশ শক্তভাবেই। এই দীর্ঘ সময়ে নাটকের পাশাপাশি অনেক ভালো ভালো সিনেমা এবং গানের অনুষ্ঠানও নিয়মিত প্রচারিত হয়েছে বিটিভিতে। বিনোদন পিয়াসী দর্শকের কাছে আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় চ্যানেলটি। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হওয়ায় নিত্যনতুন অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে এখানে। হয়েছে 'যদি কিছু মনে না করেন', 'ইত্যাদি', 'মাটি ও মানুষ' প্রভৃতির মতো বেশকিছু কালজয়ী অনুষ্ঠান। এরপর থেকেই ক্রমশ কী এমন ছন্দচু্যতি ঘটল যে, বিটিভির পতন রোধ করা যাচ্ছে না! ওই যে 'প্রেম' থেকে যাত্রা করেছিল বিটিভি সেই প্রেমই যেন হারিয়ে গেছে বিটিভি থেকে। গোড়ায় যদি যাই দেখব কাদের অংশগ্রহণে বিটিভি শক্ত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং কেন ও কখন থেকে এর পতনের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যেতে থাকে। শুরু থেকেই দেশের মঞ্চাভিনয় শিল্পীরাই ছোটপর্দার নাটকে একচ্ছত্র আধিপত্য রেখেছে এই দীর্ঘ সময়ে অভিনয় করা শিল্পীদের তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে। এছাড়া সিনেমা প্রচারে যেমন এফডিসি, গান ও নাচ, নৃত্যনাট্য প্রচারে ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি।

এরকম দেশের সাংস্কৃতিক মঞ্চগুলো থাকাতেই বিটিভিকে শিল্পী-কলাকুশলী নিয়ে অভাবে পড়তে হয়নি। সেই যে তার প্রথম প্রচারিত নাটক মুনীর চৌধুরী রচিত 'একতলা দোতলা'- তাতেও অভিনয় করেছিলেন আজকের প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য মঞ্চাভিনয় শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। সেই একটি নাটকের জন্যই মহড়া দেওয়া হয়েছিল একমাস। আর এখন? একদিন বা আধা দিনেই একটি নাটক শেষ হয়ে যায়। এভাবে দেখা যায় প্রথম থেকেই দেশের মঞ্চাভিনয় শিল্পীরাই একেবারে সামনে থেকে বিটিভিসহ সব ছোটপর্দার নাটকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। সেই মুনীর চৌধুরী, ফেরদৌসী মজুমদার, জাহানারা আহমেদ, রামেন্দু মজুমদার, সেলিম আল দীন, আতাউর রহমান, মমতাজ উদ্দিন আহমদ, ইনামুল হক, আবুল হায়াত, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, শিমূল ইউসুফ, মান্নান হীরা, আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল হোসেন, পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখসহ আরও অনেকের যারা ছিলেন তাদের সকলেরই অভিনয়ের হাতেখড়ি বিভিন্ন মঞ্চ নাটকের দল থেকে। বললে অতু্যক্তি হয় না, এ দেশে মঞ্চ হচ্ছে অভিনয় জানা, বোঝা ও শেখার প্রথম পীঠস্থান।

তবে যুগের পরিবর্তনে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়তে থাকায় চাহিদানুসারে নাটকের সংখ্যা বাড়ে, তৈরি হয় অসংখ্য নাট্য কলাকুশলী। আগে যারা অভিনয়কে প্যাশন হিসেবে নিয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মের অভিনয় শিল্পীরা সেটাকে প্রফেশন হিসেবে নিতে শুরু করেন। এভাবে ধীরে ধীরে নাটকের চরিত্রও প্যাশন ও প্রফেশন এই দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় এর গুণগত মানও আকাশ-পাতাল তফাৎ হয়ে যায়। পরিবর্তন আসতে থাকে নাটকের নানা বিষয়ে। নাটকের এই বাঁক বদলেই একপর্যায়ে যোগ হয় অনলাইনে নাটক প্রচারের প্রচলন। তখন এতো গণহারে অভিনয় শিল্পী আসবে কোত্থেকে? ততদিনে তো মঞ্চপাড়া নিজেই নানা অপ্রতুলতায় ধুঁকছে। এভাবেই বিটিভিসহ গোটা টিভি নাটকই আবেদন হারাতে থাকে। টিভি নাটক হয়ে পড়ে একদিকে যেমন প্রাণহীন অন্যদিকে বৈচিত্র্যহীনও।

নাটকের দৈন্যদশার মূলে কী এর খোঁজ-খবর নিতেও প্রথমেই মঞ্চদলগুলো কেমন আছে সেটাও জানতে হবে। জানতে হবে সেখান থেকে কেমন কলাকুশলী আসছে ছোটপর্দায়। রাষ্ট্রীয় চ্যানেলের সম্মানী কেমন আর বেসরকারি চ্যানেলগুলোর সম্মানী কেমন। কিংবা বিভিন্ন মঞ্চদলের বা হালে শুরু হওয়া ওটিটিতে সম্মানী কেমন। সম্মানী এখন বড় একটা ফ্যাক্টর। যদিও বিটিভির স্বর্ণসময়ে সম্মানী নিয়ে অত মাথাব্যথা ছিল না কারও। এখন এই সম্মানী শুধু সম্মানীই নয় মানসম্মানেরও বিষয়। কারণ, এখনকার দিনে যত কম সম্মানী তত বেশি অসম্মানজনক। নাটকের মান যেমন তেমন হয় হোক; গানের মান যেমন তেমন হয় হোক- শিল্পীদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এ প্রসঙ্গে বরেণ্য অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, 'এখন মঞ্চ থেকে টিভি নাটকে অভিনয় শিল্পীর চাহিদা পূরণ করবে কি এজন্য এখন দেশের বিভিন্ন পাবলিক ইউনিভার্সিটিসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নাট্যবিভাগ আছে। সেখান থেকেই এখন টিভি নাটকের অভিনয় শিল্পীর চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এছাড়াও তো অন্যভাবেও আসছে। তা তারা যেখান থেকেই আসুক নাটকে অভিনয় করতে হলে ভালো করে জেনে-বুঝে ও শিখে আসতে হবে।' এই যে বললেন, 'জেনে-বুঝে ও শিখে আসতে হবে'- কথাটি টিভি নাটকের জন্য বলা হলেও মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে কিন্তু বলা হয় না। কারণ, মঞ্চ তো অভিনয় জানা, বোঝা ও শেখারই তীর্থস্থান!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে