সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন আলীর প্রস্থানের দুই বছর

প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
বাংলা সংগীতের অসংখ্য গানের সুরকারের নাম কিংবদন্তি আলাউদ্দিন আলী। একসময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে একটি কথা প্রচলিত ছিল। সেটি হলো- 'আপনি আলাউদ্দিন আলীর সুরে গান করেননি, তো কিছুই করেননি। আপনার সংগীত জীবনই ব্যর্থ।' ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী থানার বাঁশবাড়ী গ্রামের এক সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই বিরল প্রতিভা আজ চলে যাওয়ার দুই বছরে পড়লেন। ২০২০ সালের আজকের দিনে ৯ আগস্ট দেহত্যাগ করেন তিনি। পিতা জাবেদ আলী ও মাতা জোহরা খাতুনের সন্তান আলাউদ্দিন তার পিতা ওস্তাদ জাবেদ আলী ও ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছ থেকে সংগীতে বুনিয়াদি শিক্ষা নেন। ১৯৬৮ সালে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে প্রথমে আলতাফ মাহমুদের সহযোগী হিসেবে যোগ দেন। পরে প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজসহ বিভিন্ন সুরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। পরে হয়ে ওঠেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে বহু জনপ্রিয় গানের এক দাপুটে পরিচালক, সুরকার ও গীতিকার। লোকজ ও ধ্রম্নপদি গানের এক অপূর্ব মেলবন্ধনে গড়ে তোলা আলাউদ্দিন আলীর সুরের নিজস্ব ধরন গোটা বাংলা সংগীতেই ভিন্ন ঘরানা হিসেবে পরিচিতি পায়। ছোটবেলাতেই বেহালা বাজানোর জন্য অল পাকিস্তান চিলড্রেনস প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান তিনি। তার মেয়ে আলীফ আলাউদ্দিনও একজন সংগীতশিল্পী। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে প্রথমে বেহালা বাদক হিসেবে কাজ করেন আলাউদ্দিন আলী। সত্তরের দশক থেকে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে দেশাত্মবোধক 'ও আমার বাংলা মা' গানের মাধ্যমে তার প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো 'সন্ধিক্ষণ' চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করে প্রশংসিত হন। ১৯৭৭ সালে 'গোলাপী এখন ট্রেনে' আর 'ফকির মজনু শাহ' চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। 'গোলাপী এখন ট্রেনে' (১৯৭৯), 'সুন্দরী' (১৯৮০), 'কসাই' এবং 'যোগাযোগ' চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালিত 'পদ্মা নদীর মাঝি' চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। চার দশকজুড়ে তৈরি করা তার গান বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। বাংলা চলচ্চিত্রে বহু শ্রোতাপ্রিয় গানের জনক আলাউদ্দিন আলী গীতিকবিও। গান লিখে তিনি ১৯৮৫ সালে একবার শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এই পুরস্কারসহ আলাউদ্দিন আলী তার গানের জন্য মোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার পুরস্কৃত হয়ে সংগীত পরিচালক হিসেবে রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। যে রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন মিলে প্রায় পাঁচ হাজার গান তৈরি করেছেন তিনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রায় ৩০০টি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বহু স্বনামধন্য শিল্পীও তার সুরে গান করেছেন। এই গুণী শিল্পীর সুরারোপিত গানের মধ্যে- 'যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়', 'এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই', 'হয় যদি বদনাম হোক আরও', 'হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ', 'দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়', 'একবার যদি কেউ ভালোবাসত', 'জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো', 'এমনও তো প্রেম হয়, 'ভালোবাসা যত বড় জীবন ততো বড় নয়', 'আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার', 'সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে', 'সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী', 'যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে, মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে', 'পারি না ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গেঁথে', 'আমার মনের ভেতর অনেক জ্বালা আগুন হইয়া জ্বলে', 'আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা', 'শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে', 'কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না', 'সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ', 'এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়', 'প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ'সহ বাংলাদেশের বহু উলেস্নখযোগ্য শ্রম্নতিমধুর গানের সুরকার ও গীতিকার তিনি। এমনকি আলাউদ্দিন আলীর সুরারোপিত 'বন্ধু তিন দিন তোর বাড়ি গেলাম দেখা পাইলাম না'- এই চটুল গানটিও ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তানের বহু শিল্পী তার সুর করা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। বাংলাদেশের যে কয়জন সংগীতজ্ঞর কাজে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সমৃদ্ধ হয়েছে আলাউদ্দিন আলী নিঃসন্দেহে তাদের শিরোভাগে থাকবেন। এই বরেণ্য গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী আলাউদ্দিন আলীর দ্বিতীয় মৃতু্যবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।