সুরসম্রাজ্ঞী লতার প্রথম মৃতু্যবার্ষিকী আজ

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
'ভারতের নাইটঅ্যাঙ্গেল'খ্যাত সুরের রানী লতা মঙ্গেশকরের প্রথম মৃতু্যবার্ষিকী আজ। গত বছরের এই দিনটিতে (৬ ফেব্রম্নয়ারি) উপমহাদেশের প্রায় দেড়শ' কোটি মানুষকে শোকাচ্ছন্ন করে ৯২ বছরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃতু্যকালে রেখে যান বহু কালজয়ী গান, যে গানগুলোর জন্য বেঁচে থাকবেন যুগ যুগান্তরে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভিতরে। যদিও লেখা হয় লতা মঙ্গেশকরের মৃতু্য মানে একটি যুগের জীবনাবসান কিন্তু যার কণ্ঠ লোকে লোকান্তরের সুরে সুরে বাজতে থাকবে তাকে অমর শিল্পী ছাড়া আর কিছুই কল্পনা করা যায় না। লতা মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে শাস্ত্রীয় গায়ক ও নাট্যশিল্পী পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর এবং শেবন্তীর কোল আলো করে ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের বহুমুখী গায়িকা ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। জীবনে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চারটি ফিল্মফেয়ার, দাদা সাহেব ফালকে, ভারতরত্ন, জাতির কন্যা, সাত কাল রত্ন পুরস্কার-২০১৪সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত এই 'সুরের রানী' আজকের 'ভাইরাল' যুগের গানের মতো একদিনে হননি। প্রায় আট দশকের পেশাদার সঙ্গীতজীবনে তিনি ২৭ হাজারের বেশি গান রেকর্ডিং করেছেন। তিনি এক হাজারের বেশি হিন্দি সিনেমা এবং ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষাসহ বেশ কিছু বিদেশি ভাষার ছবিতে ৫০০০টির বেশি গান করেছেন। লতা তার মন দোলা দেওয়া নৈপুণ্য দিয়ে সঙ্গীতের সীমানা পেছনে ঠেলে দেন। লতা মধুবালা থেকে ঐশ্বর্য্য পর্যন্ত বহু অভিনেত্রীদের জন্য গান গেয়েছেন। ১৯৪২ সালে মরাঠি সিনেমা 'কিটি হাসাল'-এর জন্য স্টুডিওতে প্রথম গান রেকর্ডিং করেন লতা। তবে কোনো অজ্ঞাত কারণে সিনেমাটি রিলিজ হলেও গানটি বাদ পড়ে। এইভাবে তার রেকর্ড করা প্রথম পেস্ন-ব্যাকটি বাদ পড়লেও পরবর্তীতে হিন্দিসহ ভারতীয় সব ভাষার গানেই এক অবিচ্ছেদ্য নামের অংশ হয়ে যান লতা। পারিবারিকভাবে নাম ছিল তার হেমা। পরবর্তীকালে বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের 'ভাওবন্ধন' নাটকের লতিকা চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার পারিবারিক নাম 'হেমা'র পরিবর্তে লতা নামটি রাখা হয়। এইভাবে হেমা নামটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও লতা নামটি কালের অংশ হয়ে যায়। মঙ্গেশকর পরিবারের সবাই কোনো না কোনোভাবে শিল্পজগতের সঙ্গে থাকায় একেবারে শিশু বয়স থেকেই লতা তার প্রতিভার পরিচয় দিয়ে রাখেন। বাবা পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন ধ্রম্নপদী সঙ্গীত পিয়াসী। অভিনয়ের পাশাপাশি গায়ক হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন। একবার তিনি এক ছাত্রকে একটি বিশেষ রাগ অনুশীলন করতে বলেন। ছাত্রটি অনুশীলন করার সময়ে একপর্যায়ে ছোট্ট লতা ছাত্রটির ভুল ধরিয়ে দেয়। এটা দেখে সেদিনই বাবা দীননাথ বুঝতে পারেন তার এ মেয়ে বড় গায়িকা হতে চলেছে। বাবা দীননাথ ছাড়াও লতা গানের তালিম নিয়েছিলেন আমানত খান, আমান আলী খানের মতো কিংবদন্তির কাছে। লতা শুধু গানই গাননি সিনেমায়ও অভিনয় করেছিলেন। ১৯৪২ সালে বাবার মৃতু্য আর আর্থিক সংকটের মুখে মুষড়ে পড়েছিল মঙ্গেশকর পরিবার। কিছুটা অর্থের প্রয়োজনেই প্রায় ছ'বছর পেশাদার অভিনয় জীবনে আটটি সিনেমায় অভিনয় করেন পাঁচ ভাই-বোনের সবচেয়ে বড় লতা মঙ্গেশকর। তবে অভিনয়ের ক্যারিয়ার দীর্ঘ না করে বরং গানের শিল্পী গানের জগতেই থেকে যান। এইখানেরও লতার গভীর দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থের মোহে অভিনয়কে ধরে না রেখে গান নিয়ে পড়ে থাকাতেই সেই লতা চিরকালের হয়ে গেলেন। কোনো সিনেমা দর্শক থেকে চিরবিস্মৃত হয়ে পড়লেও তার গান যদি কালজয়ী হয় তাহলে সে গানের রেকর্ড বাজতে থাকেই। লতার এমন বহু সিনেমা আছে যে সিনেমা আর কোনোদিন বড়পর্দায় দেখা যাবে না হয়তো ইউটিউবেও খুঁজে পাওয়া যাবে না কিন্তু সেগুলোর অনেক গানই যুগ যুগ শোনা যাবে। লতা মঙ্গেশকর হলেন সেই মাপের শিল্পী। সেজন্যই তাকে বলা হয় সুরের রানী। গোটা ভারতে লতার প্রভাব যে কী পরিমাণ সেটা বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না। একবার ১৯৮৬ সালে 'ইন্ডিয়া টু ডে'র মাধ্যমে ভারতবর্ষে শিল্প সংস্কৃতিতে কার অবদান সবচেয়ে বেশি- এমন একটি প্রশ্নের সমীক্ষা হয়। দেশের সব প্রান্তের পাঠক-পাঠিকাদের ভোটের হিসাবে দেখা যায় কিংবদন্তি সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের নাম সবার ওপরে। ভীমসেন যোশী, মকবুল ফিদা হুসেন, মোহাম্মদ রফি, রাজকাপুর, সত্যজিত রায়, সুচিত্রা সেন, উত্তম কুমার, অমিতাভ বচ্চনদের মতো বিশিষ্ট শিল্পীরাও স্থান পেয়েছেন লতার নিচের সারিতে। তবে এমন উঁচু দরের সুর সম্রাজ্ঞী হলে কী। এই সুরের জন্যও লতাকে তার জীবনের প্রথমে কম মুষড়ে পড়তে হয়নি। 'বড় বেশি চিকন গলা' এমন কথা শুনে প্রথমে একটু ঘাবড়েও গিয়েছিলেন তিনি। তখন নূর জাহান, শাম সাদ বেগমের রমরমা সময়। একটু নাকি ভারি গলার চল তখন। তবে ১৯৪৯ সালে 'মহল' সিনেমার সুপারহিট 'আয়েগা অনেওয়ালা' গানের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি লতাকে। এরপর ছুঁয়েছেন বিরতিহীনভাবে একের পর এক মন জুড়ানো সাফল্যের পালক। পেয়েছেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।