জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমায়ও দর্শক কম

প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
'সাঁতাও' সিনেমার দৃশ্যে আইনুন পুতুল
জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা 'মুখ ও মুখোশ' দিয়েই শুরু হয় দেশীয় চলচ্চিত্রের যাত্রা। এরপর টানা দেড় যুগ ধারাবাহিকভাবেই সামাজিকধর্মী বা জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে জহিরুল হক পরিচালিত এবং নায়করাজ রাজ্জাক প্রযোজিত 'রংবাজ' সিনেমার মধ্য দিয়েই শুরু হয় দেশের সর্বপ্রথম অ্যাকশনধর্মী বাণিজ্যিক সিনেমা। সেই থেকেই দর্শকও দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়। হু-হু করে বাড়তে থাকে অ্যাকশন সিনেমার দর্শক। অন্যদিকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে জীবনঘনিষ্ঠ বা সামাজিক সিনেমার দর্শক। প্রায় তিন সাড়ে তিন দশক পর্যন্ত অ্যাকশন সিনেমার দর্শকই ছিল একচেটিয়া। সামাজিক সিনেমায় কালে-ভদ্রেই উপচেপড়া দর্শক দেখা গেছে। বেশিরভাগ সিনেমাই প্রায় চলে গেছে ফ্লপের তালিকায়। তবে গত কয়েক বছর ধরে অ্যাকশন সিনেমার দর্শকও কমে আসছে। কোনো কোনোটি প্রায় দর্শকশূন্য ফ্লপও হচ্ছে। উপচেপড়া দর্শক একেবারেই হাতেগোনা দুয়েকটি সিনেমায় দেখা গেছে। এ অবস্থায় যেন আবার সামাজিক সিনেমা বা জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমাগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছে। সরকারি অনুদানেও সামাজিক ও জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়টি জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা আলোচনায়ও এসেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কৃত বা প্রশংসিতও হয়েছে। তবে এগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কৃত বা প্রশংসিত হলেও দর্শকের কাছে তেমন পাত্তাই পাচ্ছে না এগুলো। সেজন্য নির্মাতাদের কপালেও পড়ছে চিন্তার ভাঁজ। দু'একটি সিনেমায় উপচেপড়া দর্শক দেখা গেলেও বাকি সিনেমাগুলো দর্শক পাচ্ছে না। উদারহণ হিসেবে সদ্য মুক্তি পাওয়া 'সাঁতাও' সিনেমার নাম বলা যেতে পারে। সিনেমাটি সম্প্রতি ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হলেও প্রেক্ষাগৃহ সংকটে পড়লে হতাশ হন এর নির্মাতা ও কলাকুশলীরা। শেষমেশ ২৭ জানুয়ারি মাত্র ৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এটি। কিন্তু মুক্তির পরই মুখ থুবড়ে পড়ে গণঅর্থায়নে নির্মিত এই জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমাটি। একদিকে অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় যেমন দর্শক হচ্ছে না অন্যদিকে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে সামাজিক ও জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমাগুলোতেও। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দু'ধরনের সিনেমাতেই। অথচ করোনার দিনগুলো পেরিয়ে যখন 'গলুই' ও 'শান' মুক্তি পাওয়া ফ্যামিলিড্রামা নির্ভর সিনেমাতেই উপচেপড়া দর্শক দেখা গেছে। আশায় বুক বেঁধেছিলেন হল মালিকরা। আবার সে আশায় গুড়ে বালি দেখতেও বেশি সময় যায়নি। এখন ধারাবাহিকভাবেই মার খাচ্ছে সামাজিক ও অ্যাকশনধর্মী সিনেমা। কোনো কোনো সামাজিক সিনেমায় উপচেপড়া দর্শক দেখা দিলেও এর পরেই দেখা যাচ্ছে সেই আগের মতোই দর্শকখরায় ভুগছে এ ধরনের সিনেমা। এ প্রসঙ্গে চিত্র নায়িকা রোজিনা বলেন, 'এটা হচ্ছে 'লাক'-এর ব্যাপার। এই যে 'পরাণ' ও 'হাওয়া' ছবি দুটো এমন বাজার পাবে সেটা আগে থেকে কেউ ধারণা করতে পেরেছিল? পারেনি। কিন্তু আর যেসব ছবি হলে মুক্তি পেয়েছে সেগুলোতে তো দর্শক হয়নি। আর 'হাওয়া' ছবিটি তো শ্রীলংকার একটি জেলে জীবনভিত্তিক ছবির হুবহু অনুকরণ। সেই ছবিটি হিট না হলেও এখানে যে হিট হয়েছে সেটা তো 'লাক' এর কারণেই হয়েছে। আবার 'পরাণ' ছবিটি হয়েছে মিডিয়ার কারণে ব্যাপক আলোচিত হওয়া একটি ত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা নিয়ে। এভাবে দর্শক আগে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে কারণেই এর দর্শক হয়েছে। কিন্তু এমন আলোচিত ঘটনা তো সব সময়েই ঘটবে না। ঘটলেও তা নিয়ে বানানো সব ছবিতেই এমন দর্শক হবে না।' তবে অনেকে বলেন, সামাজিক সিনেমায় বিনিয়োগ বেশি না হওয়ায় দর্শক কম হলেও সে ক্ষতিটা ভিন্নভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা একটি অ্যাকশন সিনেমা থেকে যদি লগ্নিকরা টাকাটাও উঠে না আসে স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের সিনেমায় লগ্নি করা নিয়ে প্রযোজকরা আগ্রহ হারাবেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, 'আসলে আমাদের যেসব সিনেমা হল ছিল তার বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই এখন আর আগের মতো দর্শক হচ্ছে না। তাছাড়া সিনেপেস্নক্স এবং সাধারণ হলের মধ্য দিয়ে আমাদের দর্শক শ্রেণিও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। দর্শক আগে থেকেই দু'ভাগে বিভক্ত ছিল তবে সিনেপেস্নক্স হওয়ার পর এই বিভাজনটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন যেসব সামাজিক সিনেমায় দর্শক হয় সেগুলোর প্রায় সব দর্শকই সিনেপেস্নক্সের। কিন্তু অ্যাকশনধর্মী সিনেমার দর্শক মূলত মেইনস্টিমের দর্শক। তারা যেসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় থাকা বড় বড় হলে গিয়ে অ্যাকশনধর্মী সিনেমা দেখতো সে হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই এখন অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় দর্শক হচ্ছে না।'