ঊননব্বইয়ে হাসান ইমাম

প্রকাশ | ২৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
সৈয়দ হাসান ইমাম
দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম আজ পা রাখলেন জীবনের ৮৯তম বছরে। ১৯৩৫ সালের আজকের এই দিনে ভারতের বর্ধমানে মামাবাড়িতে তিনি জন্ম নেন। সেখানেই শৈশব কেটেছে নন্দিত এই অভিনেতার। এই জীবন্ত কিংবদন্তি শুধু অভিনেতাই নন, তিনি একাধারে একজন আবৃত্তিকার, সফল সংগঠক, সঙ্গীত শিল্পী। ১৯৫০ সালে কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানের এক নাটিকায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে অভিনয়জীবন শুরু হয় হাসান ইমামের। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ হাসান ইমামের জীবনের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে কাজ করেন তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ শিল্পী সভাপতি হিসেবে দীর্ঘসময় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সৈয়দ হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার ছাড়াও স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। জন্মদিনে দেশে নেই এই বরেণ্যব্যক্তি। স্ত্রীসহ সুদূর আমেরিকায় রয়েছেন হাসান ইমাম। দেশের বাইরে থাকলেও প্রতিবছর তার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান আত্মীয়স্বজন, ভক্ত অনুরাগী ও শোবিজাঙ্গনের লোকেরা। সবার ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। বলেন, 'আবৃত্তিশিল্পী ও অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। এ বয়সে পুরোপুরি ভালো থাকা না গেলেও যতটুকু সুস্থ আছি ভালোই আছি। সুস্থতার জন্য মোটামুটি নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করি। আমি আমার জীবনটা উপভোগ করেছি। নানা সংগ্রাম ও সংকটের মধ্যেও জীবনকে উপভোগ করে গেছি। আবার জন্ম নিলে আমি এই জীবনই চাইতাম।' শৈশব নিয়ে হাসান ইমাম বলেন, আমার বাবার বাড়ি ছিল বাগেরহাটে। বাবার নাম ছিল সৈয়দ সোলেমান আলী ও মা সৈয়দা সায়ীদা খাতুন। ভারতের বর্ধমানে নানা বাড়িতে আমার জন্ম। আগেকার মায়েরা যখন অন্তঃসত্ত্বা হতো তখন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে আগে তাদের বাপের বাড়িতে অবস্থান নিত। আমার বেলায়ও এমনটি ঘটেছে। আমার শৈশব কেটেছে বর্ধমানে। বাবা মারা যাওয়ার আগে চেয়েছিলেন আমি যেন মামা বাড়িতে থেকেই পড়ালেখা করি। কারণ সেখানে পড়ালেখার পরিবেশটা ভালো ছিল। পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গেও আমার সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে।' সৈয়দ হাসান ইমাম ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগ দেন। ১৯৬০ সাল থেকে হাসান ইমামের অভিনয় জীবন শুরু। এ বছর থেকে তিনি চলচ্চিত্রে এবং ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে সমগ্র পাকিস্তানের চলচ্চিত্র উৎসবে হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান লাভ করেন খান আতাউর রহমানের 'অনেক দিনের চেনা' সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষের কেন্দ্রীয় উৎসবে ডামা সার্কেল প্রযোজিত 'তাসের দেশ', 'রাজা ও রানী' এবং 'রক্তকরবী' নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করেন। ১৯৬৬-৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মঞ্চে নাটক-নাটিকা ও গণসঙ্গীত পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত প্রায় ১০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে বাংলা একাডেমির বটমূলে মঞ্চায়িত হাসান ইমামের নির্দেশিত 'রক্তকরবী' নাটকটি বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে হাসান ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর হাসান ইমাম মুজিব নগর চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ১৯৭১-এ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নাট্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। হাসান ইমাম ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ পাঠ এবং নাট্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানকে সভাপতি ও হাসান ইমামকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিবনগরে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় হাসান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জাহানারা ইমামের মৃতু্যর পর মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন সৈয়দ হাসান ইমাম। হাসান ইমাম শিল্পী লায়লা হাসানকে বিয়ে করেন। হাসান ইমামের দৃষ্টিতে একজন শিল্পীর মৌলিক গুণ হচ্ছে- ভালো মানুষ হওয়া, সৎ থাকা, মানুষসহ সব সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা থাকা। জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে এই গুণীজন বলেন, 'জীবনের অনেক কিছুই পেয়েছি, তাই আমার না পাওয়ার কোনো কষ্ট নেই।'