শাহনাজ রহমতউলস্নাহ বেঁচে থাকবেন

'একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়', 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে', 'আমার দেশের মাটির গন্ধে', 'একতারা তুই দেশের কথা বলরে আমায় বল', 'সাগরের তীর থেকে', 'যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়', 'খোলা জানালা', 'পারি না ভুলে যেতে', 'ফুলের কানে ভ্রমর এসে'- এরকম অংসখ্য গানের শিল্পী শাহনাজ রহমতউলস্নাহ আজ আমাদের মাঝে নেই। অনেকটা অভিমান নিয়েই চলে গেলেন একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পী। হঠাৎ তার মৃতু্যর সংবাদে সংগীতাঙ্গন তো বটেই গোটা সাংস্কতিক অঙ্গন এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও নেমে আসে গভীর শোক। তার অনাকাঙ্ক্ষিত খবর পেয়ে বারিধারার ৩ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাড়িটিতে ঢল নামে স্বজন ও শিল্পীদের। সবার কাছে একই বিস্ময়, তিনি তো বেশ সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন! আবার কেউ ক্ষোভ নিয়েই বলছেন, এক আকাশ অভিমান বুকে চেপে তিনি চলে গেলেন। শাহনাজ রহমতউলস্নাহ চলে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই-

প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
শাহনাজ রহমতউলস্নাহ (জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৫৩ - মৃতু্য : ২৩ মার্চ ২০১৯)
গাজী মাজহারুল আনোয়ার কষ্ট বুকে নিয়েই চলে গেল মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা হয়েছিল 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটির মধ্যদিয়ে। এই গানের গীতিকার আমি, প্রথম সুরকার ছিলেন আনোয়ার পারভেজ, শাহনাজের বড় ভাই। মূল শিল্পী ছিলেন আব্দুল জব্বার ও শাহনাজ। পরবর্তীতে সুরকার হিসেবে আনোয়ার পারভেজের উদ্যোগে আলতাফ মাহমুদ, আলাউদ্দিন আলীও সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তো, সেই 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানের শিল্পী শাহনাজ রহমতউলস্নাহ চলে গেলেন। তার এই চলে যাওয়ায় যেখানে দেশের সবশিল্পী, নির্বিশেষ সব রাজনীতিবিদের উপস্থিতি থাকাটা জরুরি ছিল। ভারত সমৃদ্ধ গানে, কেন? কারণ তাদের একজন লতা মুঙ্গেশকর আছে। তো বাইরে যখন রুনা, সাবিনা, শাহনাজ রহমতউলস্নাহর নাম উচ্চারিত হয় তখন বোঝা যায় যে তারা বাংলাদেশের শিল্পী। তারা বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর হিসেবেই তখন পরিচিত হন। কিন্তু দেশের মধ্যে শিল্পীদের রাজনৈতিক কারণে কোণঠাসা হতে হয়। শাহনাজকে আমি খুব কাছে থেকে চিনি, জানি। এতকিছু করার পরও যখন দেখল রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে মূল্যায়ন করা হয় না, তখন সে নিজেই নিজেকে নির্বাসনে নিয়ে যায়। নির্বাসনে নিয়ে সেই যে একা হয়ে গেল, কষ্ট বুকে নিয়েই শাহনাজ চলে গেল। কষ্ট আমার বুকেও রয়ে গেল। কষ্ট বুকে নিয়েই তার জন্য দোয়া করি আলস্নাহ যেন তার আত্মাকে শান্তি দেন। শবনম তার মতো শিল্পী আর জন্মাবে না আমার স্বামী রবিন ঘোষের সুরসংগীতে শাহনাজ অনেক সিনেমাতে গান গেয়েছে। রবিন যখন চলে যায় তখন শাহনাজই আমাকে বেশি সান্ত্বনা দিয়েছিল। সেই শাহনাজই এখন আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমি কতটা যে কষ্ট পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে শাহনাজ নেই। শাহনাজকে নিয়ে রবিন একটি কথা প্রায়ই বলত, শাহনাজের মতো সংগীতশিল্পী এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি জন্মাবে না। আমার তাই মনে হয়। একজন শাহনাজ রাহমতুলস্নাহর যে অসাধারণ কণ্ঠ তা যেমন কোনোভাবে কান থেকে দূরে থাকার মতো নয়, তার গান, গানের মধ্যে আবেগও দূরে রাখার মতো নয়। রুনা লায়লা ভাষাহীন হয়ে পড়েছি কণ্ঠশিল্পী শাহনাজের হঠাৎ চলে যাওয়ার খবরটা শুনে আমি ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছি। কত বছর ধরে শাহনাজকে চিনি, জানি। তার সঙ্গে কত যে স্মৃতি, এর কোনো হিসেবে নেই। খবরটা শুনে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। গত বছর একটি ঘরোয়ার অনুষ্ঠানে শাহনাজের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে। আমাদের সংগীতাঙ্গনে একের পর এক এভাবে এমন দুঃখজনক ঘটনা চলছেই। শাহনাজের চলে যাওয়ায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তাতে সত্যিই আমি ভাষাহীন হয়ে পড়েছি। আমাদের মাটির নক্ষত্রেরা সব আকাশের নক্ষত্র হয়ে যাচ্ছে। দোয়া করি আলস্নাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন। ববিতা যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবেন শাহনাজ আপার খবরটা সুদূর আমেরিকাতে বসে শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি। একজন সাংবাদিক ফোন করে যখন আমাকে খবরটি দিলেন তখন আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কিন্তু মৃতু্যই চরম সত্যি, একদিন না একদিন সবাইকে চলে যেতেই হবে। কাউকে আগে যেতে হবে, কাউকে পরে যেতে হবে। আমাকেও একদিন এমনি করেই হঠাৎ চলে যেতে হবে। শাহনাজ আপা চলে গেছেন, আমাদের সংগীতাঙ্গনের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলেও তিনি তার গানের মধ্যদিয়ে যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবেন। বিশেষত আমাকে বলতেই হয় যে তিনি দেশের গানের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন যতদিন বাংলাদেশ থাকবে। শাহনাজ আপার গাওয়া আমার লিপে তিনটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আলম খান শতভাগ সফল শিল্পী ছিলেন শাহনাজের বড় ভাই সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ আমার ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু ছিল। যে কারণে তাদের বাসায় আমার নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিল। কিন্তু আমার সুরসংগীতে শাহনাজ কোনো গানে কণ্ঠ দেয়নি- এটা যখন আজ বসে বসে ভাবছিলাম তখন নিজেই অবাক হলাম। কী অপূর্ব কণ্ঠ ছিল তার। দেশের গান, আধুনিক গান, গজলে তার অসাধারণ গায়কিতে মুগ্ধ হয়েছে এদেশের গানপ্রেমী মানুষেরা। একজন সত্যিকারের সংগীতশিল্পীর যেমন ভদ্র হওয়া উচিত শাহনাজ ঠিক তেমনি ছিল। সংগীতশিল্পী হিসেবে শাহনাজ শতভাগ সফল একজন শিল্পী ছিলেন। কনকচাঁপা তিনি ছিলেন আমাদের মায়ের মতো তিনি এভাবে হুট করে চলে যাবেন, সত্যিই ভাবিনি। এটা আমার জন্য বিশাল একটা ধাক্কা। এটাতো সত্যি আমরা যারা গান শিখেছি এবং এখনো গান করার চেষ্টা করছি তারা এই মানুষটাকে সরাসরি ফলো করেছি। তিনি ছিলেন আমাদের মায়ের মতো। তিনি ছিলেন আমাদের গার্জেনের মতো। আজ সেই মানুষটা হুট করে চলে গেলেন। নিজেকে বড় একা আর অসহায় লাগছে। শহীদুলস্নাহ ফরায়জী যার কোনো গান ফ্লপ নেই শাহনাজ রহমতউলস্নাহ এমন একজন শিল্পী ছিলেন, যার কোনো গান ফ্লপ নেই। বিশেষ করে দেশের গানে তার তুলনা হয় না। অনেক শিল্পীর কিছু গান ফ্লপ হয়। কিন্তু শাহনাজ রহমতউলস্নাহর ক্যারিয়ারে এটা নেই। দেশের গান, সিনেমার গান, আধুনিক গান সবখানেই শাহনাজ রহমতউলস্নাহ ছিলেন সফল। শাহনাজ রহমতউলস্নাহ একাধিক ভাষায় গাইতে পারতেন। তিনি ছিলেন বাঙালির গর্ব। যতদিন আমরা বেঁচে থাকব, আমাদের পরের প্রজন্ম ও বাংলা ভাষাভাষীর অনুভূতি যতদিন থাকবে ততদিন শাহনাজ রহমতউলস্নাহ বেঁচে থাকবেন। চলে যেতে হয়, এটাই স্বাভাবিক। তবে এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়াটা খুবই বেদনার। কুমার বিশ্বজিৎ মানসিক শক্তির আশ্রয়টুকু হারালাম আদর, শাসন এবং দুঃখকষ্টে মানসিক শক্তির আশ্রয়টুকু হারালাম আমি। আমি দোয়া করি মা শাহনাজ রহমতউলস্নাহকে যেন আলস্নাহ বেহেস্ত নসিব করেন। এটা খুউবই দুঃখজনক, আমাদের দেশের এমন অনেক কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আছেন যাদের নানানভাবে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। আমরা তাদের মূল্যায়ন করতে জানি না, তাদেরে কিছু দিতেও পারি না, তাদের কাছ থেকে কিছু নিতেও পারি না। এটা খুবই বেদনার বিষয়। মা শাহনাজ এমনই একজন শিল্পী ছিলেন, যার কণ্ঠের মডিউলিশন, ব্রেথ কন্ট্রোল, থ্রোয়িং, এক্সপ্রেশন বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পীর মধ্যে নেই। তার এসব বিষয় এবং তার আদর্শকে ফলো করলেই শিল্পী হওয়া যেতে পারে। তারিন তার মায়ামমতার কথা ভুলব না শ্রদ্ধেয় শাহনাজ রহমতউলস্নাহর হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়াটা আমাদের জন্য সত্যিই অনেক কষ্টের, বেদনার। শাহনাজ আপার ছেলে ফয়সালের সঙ্গে ছোটবেলায় আমি বাদল রহমানের 'কাঁঠাল বুড়ি' শর্টফিল্মে অভিনয় করেছিলাম। তিনি সে সময় শুটিংয়ে আসতেন না। কয়েকবছর আগে একটি গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেখানে দীর্ঘদিন পর তার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করি। তারপর ২০১৭ সালের একদিন তিনি আমাকে তার সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ করেন। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তার স্নেহ, মায়ামমতার কথা ভুলব না।