রাজনীতিতে আগ্রহ বাড়ছে বিনোদন তারকাদের
প্রকাশ | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হতে আদাজল খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শোবিজ তারকারা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসেই রেকর্ড। আর এর সবই আওয়ামী লীগের কোটায় থাকা সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য। যে দৌড়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৫ জন তারকাশিল্পী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এদের মধ্যে আছেন লাকী ইনাম, সুবর্ণা মুস্তাফা, রোকেয়া প্রাচী, তানভিন সুইটি, তারিন জাহান, অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, মাহিয়া মাহী, মেহের আফরোজ শাওন. শমি কায়সার, সোহানা সাবা, সৈয়দা কামরুন নাহার শাহানূর, শামিমা তুষ্টি, শিমলা ও ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর প্রমুখ।
রাজনীতির ময়দানে তারকাদের নজরকাড়া উপস্থিতি নতুন নয়। তারকা খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে দেশ-বিদেশে শোবিজ তারকারা রাজনীতিতেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেকে। নেতৃত্বও দিয়েছেন দেশকে। আজকের সারা পৃথিবীতে যে রাষ্ট্রপ্রধান সবচেয়ে আলোচিত ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কিও সিনেমায় কমেডি চরিত্রের অভিনেতা ছিলেন।
এক সময় হয়তো দেখা যাবে বাংলাদেশেরও কোনো শোবিজ তারকা এমন রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে গেছেন! কেননা, ইতোমধ্যে অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর পূর্ণমন্ত্রী হওয়ার কৃতিত্ব দেখিছেন এবং অত্যন্ত সফলভাবেই তামন্ত্রণালয় সামলেছেন। জনপ্রিয়তায় রাজনীতিকদের চেয়ে শোবিজ তারকারাও কোনো অংশে কম যান না। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বেশিও থাকে। তবে এই চিত্রটি বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি।
ভারত উপমহাদেশে গস্ন্যামার জগতের অনেক তারকাই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও গস্ন্যামার ও ক্রীড়াজগতের কয়েকজন দাপুটে তারকা রয়েছেন?
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যেসব শোবিজ তারকারা রাজনীতিতে এসেছেন তাদের উলেস্নখযোগ্য- হুমায়ূন আহমেদের 'কোথাও কেউ নেই' ধারাবাহিক নাটকের 'বাকের ভাই'খ্যাত সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, বাংলাদেশের লোকগানের জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজ। এ ছাড়া বিশিষ্ট অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, মঞ্চসারথী আতাউর রহমান, লিয়াকত আলী খান লাকী, আজিজুল হাকিম, জায়েদ খান, চয়ন ইসলাম, রফিকুল আলম, শুভ্র দেব, ফাল্গুনী হামিদ, ডলি সায়ন্তনী প্রমুখ।
এ ছাড়া আরও যারা রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন নাট্যাভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী, দিলারা ইয়াসমিন, অঞ্জনা সুলতানা, ফারহানা আমিন রত্না ওরফে নূতন, অরুণা বিশ্বাস, তারিন জাহান, চিত্রাভিনেতা ডিপজল, শাকিল খান প্রমুখ।
হালে মনে হয় এই নাম লেখানোর হার অনেক বেশি বেড়ে গেছে। নতুন যারা রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে আছেন- ফেরদৌস আহমেদ, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহী, জ্যোতিকা জ্যোতি, সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ।
বর্তমানে উলেস্নখযোগ্য হারে শোবিজ তারকাদের আসার কারণ সম্পর্কে এক রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, 'ক্রীড়া হোক আর শোবিজ হোক, তারা হচ্ছেন এক ধরনের বসন্তের কোকিল। দেখেন একসময় যখন রাজনীতিতে টাকা ছিল না উল্টো নিজের জমিজমা বিক্রি করতে হতো রাজনীতি করতে গিয়ে তখন কিন্তু শোবিজের কেউই রাজনীতিতে আগ্রহী হতেন না। হালে শোবিজ তারকাদের রাজনীতিতে প্রবেশের প্রধান কারণই হচ্ছে এই টাকা। মূলত এই টাকার কারণেই আবার তাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে ভিড়ার হিড়িক পড়ে যায়। এটা বিগত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেও দেখা গেছে। পরে যখন দল ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছে তখন তারাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে রাজনীতি থেকে।'
জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনির খানও বিএনপিতে সক্রিয় ছিলেন। পরে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে আরেক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর এখনো মোটামুটি সক্রিয়। এ ছাড়া বিএনপির হয়ে আরও একাধিক শোবিজ তারকা নিজেদের নামভুক্ত করেছেন : চিত্রনায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল, চিত্রাভিনেতা আহমদ শরীফ, হেলাল খান, রিনা খান, চিত্রাভিনেত্রী মৌসুমী, কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা, রিজিয়া পারভীন, বস্ন্যাক ডায়মন্ড খ্যাত বেবী নাজনীন, নাজমুন মুনিরা ন্যান্সী প্রমুখ। এদের কেউ অবশ্য তোপে পড়েও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
এ ছাড়া প্রথমে আওয়ামী এবং পরে জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা (মাসুদ পারভেজ), জাতীয় পার্টির হয়ে ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন মাইলসের প্রধান ভোকাল শাফিন আহমেদ।
তবে রাজনীতিতে নাম লেখানোর আগে শোবিজের তারকারা ভুলে যান, রাজনীতির পস্ন্যাটফর্ম আর শোবিজের পস্ন্যাটফর্ম এক নয়। রাজনীতির পস্ন্যাটফর্ম সম্পূর্ণ নীতি ও আদর্শে গড়া পস্ন্যাটফর্ম। আর শোবিজের পস্ন্যাটফর্ম হচ্ছে যেখানে যেমন চরিত্র সেখানে তেমন মেকাপচর্চা। তখন চরিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাকে চরিত্রের রংও বদলে ফেলতে হয়। রঙ্গমঞ্চের জন্য সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এ দেশে বরবরই দেখা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের সঙ্গে তারকারা ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলছেন। দল যখন ক্ষমতায় না থাকে তখন তারা রাজনীতি থেকে সরে পড়েন বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এর কারণ শোবিজের তারকারা রাজনীতিতে নাম লেখালেও দলের কর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না- যা দলের নীতি ও আদর্শেরও পরিপন্থি। দলীয় দু-একটা কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তারা চেহারা দেখান আর আদায় করে নেন নানা রকম সুবিধা। আর যখন ক্ষমতার পটরিবর্তন ঘটে সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভোলও পাল্টে যায়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী অনেক শিল্পীকেই জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠতে দেখা গেছে। এই ভোল পাল্টানো সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে শোবিজের তারকাদের মধ্যেই। কারণ রাজনীতির সঙ্গে তারা রঙ্গমঞ্চ ও জনতার মঞ্চকে এক করে ফেলেন। অভিনয়ে যেমন চরিত্র অনুযায়ী মেকাপ হয়- রাজনীতিতেও তারা সে রকম যেমন রাজনীতির পস্ন্যাটফর্ম তেমন রাজনীতিক হয়ে যান। এই রঙ্গমঞ্চসুলভ চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে যদি সমাজসেবামূলক চরিত্রে কাজ করতে পারেন তাহলে এ দেশের সমাজ বদলে দিতেও অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারেন শোবিজ তারকারা।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত শোবিজের শীর্ষস্থানীয় তারকা টানার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক পস্ন্যাটফর্মের চেয়ে এগিয়ে আছে। নামগুলোর তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, দেশের শোবিজ তারকাদের মধ্যে শীর্ষ তারকা আওয়ামী লীগের হয়েই বেশি আছেন।