অনেক গভীর আবেগের গান, একুশের গান

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেসব গান রচনা করা হয়, সেগুলোকেই বলে দেশাত্মবোধক বা দেশের গান। এই দেশের গান আজকাল থেকে প্রচলিত নয়, সেই চন্ডীদাস, বিদ্যাপতিদেরও আগে থেকেই যেমন এই গান প্রচলিত হয়ে আসছে, তেমনি বাংলাদেশের '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশপ্রেমমূলক গানও নতুন এক মাত্রা এনে দিয়েছে এই দেশাত্মবোধক গানে। এই দেশপ্রেমমূলক গানের মধ্যে আবার একুশের গান ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। একুশের প্রথম গান মূলত প্রভাতফেরির গান। আর সেই গানের কলি ছিল, 'মৃতু্যকে যারা তুচ্ছ করিল/ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে'। এই গানের গীতিকার ছিলেন ন্যাপ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদের বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার মোশারেফউদ্দিন আহমেদ। তখন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ দিবসের প্রভাতফেরিতে এই গান গাওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আহমদ রফিক। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গাজীউল হকের 'ভুলবো না ভুলবো না' গানের কথাও শোনা যায়। প্রথম গান নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। গীতিকার ও সুরকার মোমিনুল হক বলেছেন, সম্ভবত গাজীউল হকের গানটিই প্রথম গান। তবে একুশের গান কোনটি প্রথম কোনটি দ্বিতীয় এসব হিসাবের মধ্যে না গিয়ে যে গানটি সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়েছে, সেটা আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি' নামের বিখ্যাত গানটি। কেন এই গানটি এত বেশি হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠল, এর কারণ সম্পর্কে অনেকে বলেছেন, মূলত আলতাফ মাহমুদের সুরের কারণেই গানটি আরও হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। গানটিতে তার দেওয়া সুরের ধারা এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে, পরবর্তী সময় এই গানটি মানুষের কণ্ঠের নিয়মিত রুটিন ওয়ার্কের মতো হয়ে যায়। যে কারণে তার এই গানটির ধারেকাছেও আর কোনো গান দাঁড়াতে পারেনি। গানটি যতটা না আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর কথার জন্য, এর চেয়ে বেশি আলতাফ মাহমুদের দেওয়া সুরের কারণেই এই গানটি ব্যঞ্জনা এতটা হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে যে, এই গানটি একুশের গান হিসেবে চিরকালীন হয়ে যায়। এ ছাড়া একুশে উপলক্ষে আরও কিছু গান পাওয়া গেছে, যেগুলোর গীতিকারের নাম পাওয়া যায়নি। হয়ত সেই গীতিকাররাই নিজেদের নাম চেপে গিয়েছেন এ কারণে যে, যেখানে আলতাফ মাহমুদের দেওয়া সুরের গানটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে, তাদের গান কি সেখানে আর পাত্তা পাবে! ফলে এ রকম অজ্ঞাত গীতিকারের গান হিসেবে যেসব গান আরও আছে, এর মধ্যে আবদুল মতিন 'রক্ত শপথ' নামে এক সংকলনে বলেছেন, তোফাজ্জল হোসেনের 'রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমাদের স্মরণ করি' এমন একটি গান গীতিকার হিসেবে যেখানে কারও নাম নেই। পরে এ রকম আরও গান পাওয়া গেছে যেমন, 'সালাম বরকত রফিক জব্বার তোমরা মোদের ভাই/তোমাদের সেই ত্যাগের দিনটি আমরা ভুলি নাই'। হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশে ফেব্রম্নয়ারি নিয়ে উলেস্নখযোগ্য সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে ২১ ফেব্রম্নয়ারি। ডিএ রশীদ ও মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ও প্রথম শহীদ মিনারের ছবিসংবলিত ওই সংকলনে তোফাজ্জল হোসেনের লেখা একুশের নতুন গান ছিল। এই গান ১৯৫৬ সালে প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়। একটি দেশ ও তার জাতির বিরাট সাফল্যকে মহিমান্বিত করে তুলতে দেশপ্রেমমূলক গানের বিকল্প নেই। সেটা অমর একুশে কেন্দ্র করেই হোক আর মহান '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই হোক। একটি দেশাত্মবোধক গান অন্তরের গভীর থেকে কী যে প্রভাব ফেলে সেটা দেখা গেছে, ভারতের প্রথম মহাকাশচারীকে যখন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন 'উপর থেকে ভারতকে কেমন লাগল'- তখন তিনি মনের একটি ভাবে প্রকাশ করার জন্য তার জবাব দিতে বেছে নেন কবি ইকবালের ভারতস্তুতি গাঁথামূলক দেশাত্মবোধক গান- 'সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা'। এই গানটি লেখা হয়েছিল যখন গোটা ভারত উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশের পদতলে। তবে ব্রিটিশের আগে-পরে অনেক ভাষায় অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান হয়েছে এই উপমহাদেশে। বাংলা ভাষায়ও বহু দেশাত্মবোধক গান হয়েছে, যার কোনো কোনোটি কালজয়ী ও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। আজও বারবার ঘুরেফিরে আসছে সেসব গান শিল্পীদের কণ্ঠে-কণ্ঠে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এর মধ্যে দেশাত্মবোধক গান সবচেয়ে বেশি অনুরণিত হয় ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে। যে গান মানুষের মনের কথা বলে, ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা বলে, জীবনযুদ্ধে বেপথ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে নতুন করে উদ্দীপনা দেয়। জনশ্রম্নতি আছে, মোগল আমলে সম্রাট আকবরের দরবারের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ তানসেন গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন। প্রতু্যষে ফুল ফোটাতে পারতেন। একটি খাঁটি দেশাত্মবোধক গান এমনই। বাংলা ভাষায় বহু আঙ্গিকের দারুণ বৈচিত্র্যময় গান হয়েছে। পলস্নীগীতি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, টপ্পা, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লালনগীতি, পঞ্চকবির গান, লোকগান, নানান উপজাতির গান ও দেশাত্মবোধক গানের সমহারে বাংলা গান ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বিভিন্ন যুগসন্ধিক্ষণে, সংকটকালে, যুদ্ধে দেশাত্মবোধক গান আমাদের যেমন সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে তেমন দেশের প্রতি অকৃত্রিম প্রেমও জুগিয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, '৪৭-এর দেশভাগ, '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভু্যত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি অর্জনে দেশাত্মবোধক গান আমাদের একটি জাতি হিসেবে গঠনে অশেষ ঋণী করেছে। রবিঠাকুরের 'ও আমার দেশের মাটি', 'বাংলার মাটি, বাংলার জল', দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'ধন ধান্য পুষ্পে ভরা', অতুল প্রসাদের 'মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা' বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছে। রজনীকান্তের 'মায়ের দেয়া মোটা কাপড়' স্বদেশি আন্দোলনে, ব্রিটিশ পণ্য বর্জনে জনমত গঠনে, নজরুলের 'কারার ঐ লৌহ কপাট', 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু', 'ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি' গানগুলো ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশাত্মবোধক গানের প্রতিটি বর্ণে বর্ণে দেশপ্রেম থাকায় ওইসব গানের ভান্ডার থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা' গানটি। যা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল। যে গান দেশ ও দশের কথা বলে, দেশের মানুষকে একই পাটাতনে আসার কথা বলে, অশুভ শক্তিকে বিতারিত করার কথা বলে, তেমন প্রেরণামূলক গানই দেশাত্মবোধক গান। এই গান অশুভ শক্তিকে দমনের জন্য, যুদ্ধযাত্রার জন্য, যুদ্ধজয়ের জন্য, দেশ গঠনের জন্য মানুষকে একটা বাড়তি শক্তি এনে দেয়। দেশাত্মবোধক গানের সার্থকতা এখানেই।