আজ গোলাম মুস্তাফার জন্মদিন

প্রকাশ | ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
গোলাম মুস্তাফা
যার মধ্যে তুমুল সৃষ্টিশীল গুণ থাকে তিনিই হতে পারেন সব্যসাচী। বাংলাদেশের অভিনয়ের জগতে সেরকম সব্যসাচী শিল্পী বলতে গেলে একেবারেই নেই। একসময়ে যাও ছিল এখন তো একেবারেই নেই। সেরকমই এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী, বাংলাদেশের বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী, শক্তিমান অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা। বেতার, টিভি, মঞ্চ, চলচ্চিত্র এ চার মাধ্যমেই তিনি তার শক্তিশালী অভিনয়ের ছাপ রেখে গেছেন। যে ছাপ কখনোই মুছে যাওয়ার মতো নয়। দোর্দন্ড প্রতাপের সঙ্গে অভিনয় করে যাওয়া এই চলচ্চিত্র অভিনেতা তার অভিনয়ের জাদু দিয়ে দর্শককে যেভাবে সম্মোহিত করে গেছেন তার প্রয়াণের মধ্যদিয়ে রেখে গেছেন এক চির শূন্যতা। তাকে মানুষ খল চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে জানলেও চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ারে প্রথমে সুজাতা ছিলেন তার নায়িকা। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টেলিভিশনেও বেশ কয়েকটি নাটকে তার নায়িকা ছিলেন সুজাতা। এদেশের চলচ্চিত্রে যারা ছোটপর্দা থেকে বড় পর্দায় গেছেন তাদের পূর্বসূরি হিসেবে গোলাম মুস্তাফাই সবচেয়ে বেশি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন। গোলাম মুস্তাফা ঢাকা টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে নাটকে অভিনয় শুরু করেন। প্রথমদিকে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নাটকে নায়ক চরিত্রে ছিলেন। সে সময়েই সহকর্মী অভিনেত্রী হোসনে আরার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তার মেয়ে সুবর্ণা মুস্তাফা একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। অপর মেয়ে ক্যামেলিয়া মুস্তাফা। মঞ্চ নাটককে জনপ্রিয় করার পেছনেও গোলাম মুস্তাফার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বেতার নাটককেও শ্রোতাদের কাছে হৃদয়গ্রাহী করার পেছনে তিনি বিরাট অবদান রাখেন। কবিতা আবৃত্তিকে শিল্পের পর্যায় উন্নীত করায় তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে তিনি বরিশালের পিরোজপুর মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ৯১তম জন্মদিন। একজন নিবেদিত সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে গোলাম মুস্তাফা ছিলেন বাংলাদেশের মঞ্চ, টিভি বা চলচ্চিত্রে প্রথমসারির অভিনেতা। বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেছেন বেশকিছু। সেই বিজ্ঞাপনচিত্রগুলোও দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। স্বীকৃত ছিলেন লেখক হিসেবেও। বিভিন্ন সাময়িকীতে আধুনিক চলচ্চিত্র ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি কর্নেল মেইগস রচিত 'ফেয়ার উইন্ড টু ভার্জিনিয়া' গ্রন্থের সুপাঠ্য অনুবাদ করেন। ইউসিস, ঢাকা প্রকাশিত এ অনুবাদ গ্রন্থটির বাংলা নাম 'নতুন যুগের ভোরে'। তার অনেক অনুবাদ বিভিন্ন সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়। প্রচুর পড়াশোনা করতেন তিনি। শুটিং সেটেও বই নিয়ে যেতেন। শুটিংয়ের ফাঁকে বই পড়তেন। আবৃত্তি করতেন। তার এই চর্চা অভিনয়েও ভালো প্রভাব পড়েছিল। ১৯৩৪ সালের ২ মার্চ বরিশালের দপদপিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গোলাম মুস্তাফা। বাবা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। শুরুতে সিনেমায় বা টিভিতে গোলাম মুস্তাফার নায়িকা ছিলেন সুজাতা। পারফেক্ট স্টাইলিশ অভিনেতা বলতে যা বোঝায় সেগুণ গোলাম মুস্তাফার ছিল। খল অভিনয়ে অধিকাংশ ছবিতে বা নাটকে তার ভূমিকা ছিল শহুরে সজ্জন ব্যক্তির পাশাপাশি অন্তরে কূটিলতার প্রকাশ- এরকম বর্ণচোরা চরিত্র। তিনি দেখিয়েছিলেন, ভিলেনরাও সুন্দর-স্মার্ট হতে পারে। অতি অভিনয়, মেলোড্রামা, মার-মার, কাট-কাট এরকম উচ্চস্বরে সংলাপ না দিয়েও একজন খলনায়ক সুঅভিনয় করতে পারে অত্যন্ত সাবলীলভাবে; যা ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য ছিল বড় পাওয়া। বহু বৈচিত্র্যের চরিত্রে ভার্সেটাইল অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি। সব চরিত্রেই ঢুকে পড়ার মতো চমৎকার সক্ষমতা ছিল তার। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে নাট্যাভিনয় শুরু করা গোলাম মুস্তাফা চিত্রজগতে আসেন প্রামাণ্যচিত্র 'এক একর জমি'তে অভিনয়ের মাধ্যমে। প্রথম অভিনীত ছবি এহতেশাম পরিচালিত 'রাজধানীর বুকে'। ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে তিনি ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। মূলত প্রথম ছবি থেকেই তিনি অভিনয়ে পারদর্শিতা দেখান। এরপরে নায়ক, সহনায়ক, খলনায়কসহ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। গোলাম মুস্তাফা বাংলা ও উর্দু মিলে তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নায়ক, খলনায়ক এবং সহ-নায়ক হিসেবে উলেস্নখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে- 'রাজধানীর বুকে', 'চান্দা', 'নিজেকে হারায়ে খুঁজি', 'রূপালী সৈকতে', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'সূর্যসংগ্রাম', 'আলীবাবা চলিস্নশ চোর', 'রক্তাক্ত বাংলা', 'সীমানা পেরিয়ে', 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী', 'শুভদা', 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'ধীরে বহে মেঘনা', 'চন্দ্রনাথ', 'দেবদাস' ইত্যাদি। ১৯৮০ সালে 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য গোলাম মুস্তাফা সেরা পার্শ্বচরিত্র অভিনেতা এবং ১৯৮৬ সালে 'শুভদা' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০১ সালে একুশে পদক সম্মানে ভূষিত হন। আজ থেকে ২২ বছর আগে ২০০৩ সালে ২১ ফেব্রম্নয়ারির মাত্র একদিন আগে এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও ক্ষণজন্মা অভিনেতা লোকান্তরিত হন। আজ তিনি বাস্তবে না থাকলেও গুণী এই ব্যক্তিত্বকে এখনো মনে রেখেছেন দর্শকরা। ঢালিউডের ইতিহাসে তিনি থেকে যাবেন একটি অমোচনীয় সম্মানজনক স্থানে।