রোকেয়া প্রাচী, বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টামন্ডলীর অন্যতম সদস্য আসিফ নজরুলের সাবেক স্ত্রীও বটে। আলাদা ঘরানার নাটকের অভিনেত্রী হিসেবে দর্শকনন্দিতও বটে। কিন্তু এই দর্শকনন্দিত থেকে হঠাৎ ভয়ানক দর্শকনিন্দিত অভিনেত্রীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। শুরু থেকেই নিজেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রবল বৈরী হিসেবে প্রকাশ করে এই দর্শকনিন্দিত শিল্পীতে রূপান্তরিত হন। প্রাচীন গ্রিক পুরাণে যেমন কোনো মানুষ থেকে অন্য কিম্ভূত প্রাণী হয়ে যাওয়া।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী থেকে জননিন্দিত অভিনেত্রী না হলে
এমনি-এমনিতেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রোকেয়া প্রাচীর
ওপর হামলা হয়েছে?
গত বুধবার সন্ধ্যায় রোকেয়া প্রাচীর নেতৃত্বে একদল সংস্কৃতিকর্মী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শোক দিবস উপলক্ষে প্রদীপ প্রজ্বলন করে। এ সময় ৩০-৩৫ জনের একটি দল লাঠিসোটা নিয়ে এসে রোকেয়া প্রাচীর ওপর হামলা করে। জানা গেছে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী রোকেয়া প্রাচী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যান। এ সময় আরও ৭০-৮০ জন সংস্কৃতিকর্মী রোকেয়া প্রাচীর সঙ্গে যোগ দেন। মোমবাতি প্রজ্বলন কর্মসূচি শেষ হওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন ব্যক্তি লাঠিসোটা হাতে রোকেয়া প্রাচীসহ অন্যদের ওপর হামলা চালান। আহত অবস্থায় রোকেয়া প্রাচীকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রোকেয়া প্রাচী নিজেও। তিনি বলেন, 'সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছিলাম। হঠাৎ আমাদের ঘিরে ধরে বেধড়ক পেটানো হয়।'
গুরুতর আহত হয়েছেন- এমন অভিযোগ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোকেয়া প্রাচী বলেন, 'যারা পিটিয়েছে, তারা আমাকে টার্গেট করে এসেছে। প্রত্যেককে আমার শিক্ষিত মনে হয়েছে। তারা খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছে। তাদের কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি, তারা দুষ্কৃতকারী নন।'
এই যে কথাবার্তা শুনেই তিনি বুঝতে পেরেছেন তারা ছাত্র, সজ্জন- তাহলে এই ছাত্ররা, এই সজ্জনরা তার ওপর কেন কীসের কারণে এত ক্ষীপ্ত হলো, যে কারণে তিনি মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাদের ক্ষোভের দহন থেকে মুক্ত হলেন না? কিসের জন্য? কারণ, তিনি ছাত্রদের এই বিশাল অর্জন, '৭১ এর পর সব আন্দোলকে ছাড়িয়ে যাওয়া এত বড় আন্দোলকে সমর্থন করতে পারলেন না, এরই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যদি তিনি একাত্তরে প্রাপ্ত বয়স্ক হতেন, তার আজকের বয়সি হতেন, তাহলে বর্তমানের এই চরিত্র অনুযায়ী তখনো, '৭১ এর বিজয়কেও তখনকার রাজাকারদের মতোই প্রত্যাখ্যান করতেন। আজকে যেমন- ছাত্র আন্দোলনকে, আন্দোলনের বিজয়কে প্রত্যাখ্যান করছেন।
অথচ এই বিজয় '৭১ এর বিজয়ের চেয়েও অনেক বিশাল। '৭১ এর বিজয়ের পেছনে ছিল প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ। ভারতসহ প্রতিবেশী দেশসমূহের সর্বাত্মক সহযোগিতা। বাইরের দেশের আধুনিক অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্রের সহযোগিতা। সেই সঙ্গে পরে ভারতের বিপুল সামরিক বাহিনী দিয়ে সহযোগিতা। উন্নত অফিসার দিয়ে সহযোগিতা। সর্বোপরি এতে যার সঙ্গে লড়াই ছিল, সে দেশটি ছিল দেড় হাজার মাইল দূরে। কেন্দ্রীয় সরকারও দেড় হাজার মাইল দূরে। কেন্দ্রীয় রাজধানী দেড় হাজার মাইল দূরে। সে দেশের জনতার সঙ্গেও নেই কোনো সরাসরি সংযোগ। ফলে সে দেশ থেকে পেটোয়া বাহিনীও থাকার সুযোগ নেই। সবে ধন কিছু বাঙালি রাজাকারই ছিল। এমন বিপুল সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেই বিজয় এসেছিল '৭১ এ। কিন্তু এরপরও সেই বিজয় ছিল এই আজকের ছাত্র আন্দোলনের মতো বিপুল জনতা থাকাতেই। কাজেই শুধু আওয়ামী লীগ দিয়ে সেই বিজয় কখনোই আসত না।
অথচ এই ছাত্র আন্দোলনে তো গোটা দেশটাই সরকারের কব্জায়। প্রশাসন তার। পুলিশ তার। ছাত্রদের হাতে শুধু লাঠিসোটা। আর এর বিপরীতে আগ্নেয়াস্ত্র, কাটা রাইফেল, চাপাতিসহ হেলমেটবাহিনী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ তার। কী নেই তার। কেন্দ্রীয় সরকার, তথা রাজধানী সেকেন্ড দূরত্বেও নেই। চারদিকে থানা-পুলিশ। শুধু ছিল না দেশের বিপুল নিরস্ত্র জনতামন্ডলী।
এরপরও এই নিরস্ত্র জনতার পক্ষেও থাকল না প্রাচী। যে নিরস্ত্র অরাজনৈতিক পুরো জনতা সমর্থন দিয়েছে, অরাজনৈতিক ছাত্রসমাজকে। ওরা বিএনপি-জামায়াত হলে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র কোথায়? একটাও কি পাওয়া গেছে? হিংসা আর নির্বুদ্ধিতার জন্যই এত বড় বিজয়কেও সমর্থন করতে পারেনি প্রাচী। বরং প্রবল বৈরী হয়ে 'আয়নাঘরে'র পক্ষেই হয়ে রইলেন। ছাত্র আন্দোলন যাতে কোনোভাবেই সফল না হতে পারে, সে জন্য একে তৃতীয় পক্ষের ছিনতাই হয়ে যাওয়া আন্দোলনও বলেছেন প্রাচী। ছাত্রদের সঙ্গে থাকা বিপুল জনতাকেও বিএনপি-জামায়াত বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। ছাত্র আন্দোলন বিফল করার উদ্দেশে বলেন, 'ছাত্রদের আন্দোলন ছিনতাই করে একদল রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ছাত্রদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে চক্রান্ত করে রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করছে একটি মহল। এই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সাংবাদিক-পুলিশ কেউই। বিদেশ থেকে চক্রান্ত হচ্ছে। এই ফাঁদে পা দেবেন না। তারা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিতে চায়। যারা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংস করতে চায়, তাদের হাতের পুতুল হবেন না আপনারা। তাই অভিভাবকদের অনুরোধ করব, আপনার সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে নিন।' কিন্তু সব প্রচেষ্টাই অরণ্যে রোদন হয়ে যায় রোকেয়া প্রাচীর।
কিন্তু প্রাচীর বিগত আওয়ামী সরকারের এত দালালি, এত মায়াকান্না কেন? এর পেছনেও অনেক কারণ আছে। তিনি সিনেমা বানানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের তদবির করে বেআইনিভাবে পৌনে এক কোটি টাকার অনুদান নিয়েছেন। এ ছাড়া আরও বহু সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। ফলে একজন শিল্পী হয়েও এমন জঘন্য ন্যক্কারজনক অশিল্পীসুলভ আচরণের জন্যই এই ক্ষোভের ঝাল মিটানো হয় প্রাচীর ওপর দিয়ে। এমতাবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন কিনা, জানতে চাইলে এই অভিনেত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমি জীবনটা নিয়ে ওখান থেকে পালিয়েছি। হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পাইনি। যদি সেখানেও আক্রমণের শিকার হই। রাস্তা পার হয়েছি ধমক খেতে খেতে। ওরা বারবার বলছিল, 'ওরে পুলিশের হাতে তুলে দে'। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা কি ধানমন্ডি ৩২ যাওয়া যাবে না বলে কোনো রুল জারি করেছেন? সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছে একটা জায়গা, সেখানেও আমাকে এভাবে পেটানো হল। এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।'
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। বুধবার এই বাড়িতে অবস্থান নিয়ে রোকেয়া প্রাচী ফেসবুকে লিখেছেন, 'আছি ধানমন্ডি ৩২। হোক সব হত্যার, সব নৈরাজ্যের বিচার।' এভাবেই প্রকাশ করলেন প্রাচীর ৩২ নম্বর প্রেম।
তিনি আরও লিখেছেন, 'বিচার হোক বাঙালির ইতিহাস হত্যার, আছি। আমরাও বিচার চাই। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে স্মরণ করব স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস। আছি পুড়ে যাওয়া ৩২-এ।'
অথচ এই রোকেয়া প্রাচীদের যে ৩২ নম্বরের প্রতি এত প্রেম, সেই ঠিকানারই শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন।
যার দেশ ছাড়ার খবর প্রকাশ্যে আসার পরই আওয়ামী লীগ এবং দলটির সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশ ছাড়াসহ আত্মগোপনে চলে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের উপস্থিতি খুব একটা নেই। কিন্তু এখনো সরব আছেন আওয়ামী লীগের কর্মী ও অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। কীসের জোরে? যাদের দর্শক হিসেবে পেয়ে শিল্পী হিসেবে যে খ্যাতি পেয়েছেন, সেই বাংলাদেশের বিপুল জনতার একজনও যে আর হাসিনার পক্ষে নেই। সব ছাত্রদের পক্ষে। তাহলে রোকেয়া প্রাচী এত সাহস পান কোথায়?
যে জনতা তার পাশে নেই, সেই জনতার সমর্থন ছাড়াই এর আগে ফেসবুকে রোকেয়া প্রাচী ঘোষণা দেন, ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতু্যবার্ষিকীতে মিছিল নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে উপস্থিত হওয়ার। একটি ছবি শেয়ার করে ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, 'আমরা জেগে উঠব এই ধ্বংস থেকে। জেগে উঠব আগুনে পোড়া ৩২-এর এই ঘর থেকে। জেগে উঠব নিভে যাওয়া ছাই থেকে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভেবেছ সব সাহস পুড়েছে? পুড়েছ তোমরা! আমরা বাঙালি এই ছাইভস্ম থেকেই উঠব আবার আগুন হয়ে জেগে! জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।'
কিন্তু যার পাশে একজনও জনতা থাকে না, তার তো কিছুই থাকে না। তখন তো তাকে জনরোষের শিকার হতেই হয়। এটা কি '৭১ এ দেখা যায়নি? সেই বিজয়ের পর বাংলার জনতা প্রথমেই কাদের ওপর ফুঁসে উঠেছিল মনে নেই? রোকেয়া প্রাচী যেন সেই '৭১ এর বীর আর এই ৩৬ জুলাইয়ের বীর সেনানীদের প্রতিপক্ষ কলাবরেটদের একজন হয়েই আসেন ২০২৪ এর ৫ আগস্টের বিজয়োলস্নাসে, ৩২ নম্বরে।