বেতার, টিভি, মঞ্চ, চলচ্চিত্র এই চার মাধ্যমেই অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন সব্যসাচী অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা। বরেণ্য এই অভিনেতার জন্মদিন আজ। ১৯৩৫ সালের ২ মার্চ বরিশাল জেলার পিরোজপুর মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন। সাব-রেজিস্ট্রার বাবা আর গৃহিণী মায়ের ঘরেই বড় হয়েছেন তিনি। খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। জানা যায়, স্কুল-কলেজ জীবনেই নাটকে অভিনয় করার শখ ছিল। ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে বরিশাল অশ্বিনী কুমার টাউন হল মঞ্চে বি ডি হাবিবুলস্নাহ রচিত 'পলস্নীমঙ্গল' নাটকে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। একই বছর বরিশাল জেলা স্কুলে 'ফাতেহা ইয়াজ দাহাম' উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত 'ঐ নাম' কবিতাটি আবৃত্তি করেন এবং আবৃত্তিকার হিসেবে তিনি দর্শকদের নজর কাড়েন। গোলাম মুস্তাফা পঞ্চাশের দশকের মধ্য সময়ে ঢাকায় আসেন এবং নাট্যাভিনয় শুরু করেন। তিনি প্রথমে চিত্রজগতে আসেন প্রামাণ্যচিত্র 'এক একর জমি'তে অভিনয়ের মাধ্যমে। প্রথম অভিনীত সিনেমা এহতেশাম পরিচালিত 'রাজধানীর বুকে'। তিনি নায়ক, সহনায়ক, খলনায়কসহ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
তবে, তিনি অভিনয় জীবনে খলনায়ক হিসেবেই বেশি সফল হয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'হারানো দিন ছবিতে মদ্যপ জমিদারের ভূমিকায় তার অভিনয়ের কথা অনেকের স্মৃতিতে এখনো অমলিন।
গোলাম মুস্তাফা বাংলা ও উর্দু মিলে প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত উলেস্নখযোগ্য চলচ্চিত্রসমূহ হচ্ছে- হারানো দিন, চান্দা, নাচঘর, পীরিত না জানে রীত, কাজল, ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো, 'তালাশ, আলিবাবা চলিস্নশ চোর, বন্ধন, বেগানা, কারওয়াঁ, ক্যায়সে কহু, নদী ও নারী, কার বউ, ইস্ ধরতি পর, ইন্ধন, চাওয়া পাওয়া, দাসী, সোহানা সফর, নতুন দিগন্ত, গোরী, ভাইয়া, প্রতিকার, দুই রাজকুমার, বলাকা মন, বিনিময়, সন্তান, নিজেরে হারিয়ে খুঁজি, রং বদলায়, সোনার খেলনা, কে আসল কে নকল, মিশর কুমারী, রক্তাক্ত বাংলা, তিতাস একটি নদীর নাম, সূর্যসংগ্রাম, ধীরে বহে মেঘনা, স্স্নোগান, সীমানা পেরিয়ে, সারেং বৌ, পদ্মা নদীর মাঝি, মমতা, পিঞ্জর, বন্দিনী, আলোর পথে, দম মারো দম, ফকির মজনু শাহ, রূপালী সৈকতে, কার পাপে, ছোট মা, ঈমান, সখি তুমি কার, লুটেরা, মোকাবেলা, রাজনন্দিনী, জংলীরাণী, গাংচিল, অভিযোগ, আনারকলি, স্বামী, কলমীলতা, আকাশ পরি, টক্কর, লালু ভুলু, প্রাণ সজনী, নাজমা, জালিম, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, দেবদাস, শক্তি, চন্দ্রনাথ, সুখ দুখের সাথী, লক্ষ্ণীবধূ, হিসাব নিকাশ, শুভদা, দোষী, অন্যায়, সুরুজ মিঞা, অবিচার, ব্যথার দান, রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত, স্ত্রী, আশা ভালোবাসা, জীবন সংসার, শ্রাবণ মেঘের দিন, ইত্যাদি।
গোলাম মুস্তাফা ১৯৮০ সালে এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্বচরিত্র অভিনেতা এবং ১৯৮৬ সালে শুভদা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০১ সালে একুশে পদক সম্মানে ভূষিত হন। তিনি বাচসাস পুরস্কারও লাভ করেন।
ব্যক্তি জীবনে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন হোসনে আরা মুস্তাফাকে। দুই কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক তিনি। তার এক কন্যা সুবর্ণা মুস্তাফা আমাদের দেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী। অভিনয় জগতে তিনি যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান এ অভিনেতা। মৃতু্যর পর থেকে প্রতি বছর 'গোলাম মুস্তাফা স্মরণ ও একুশের প্রথম প্রহর উদযাপন করে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। জন্মদিনে এ অভিনেতাকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।