বিশ্বে সুস্থতার হার ৪৪% দেশে অর্ধেকের কম

প্রকাশ | ০১ জুন ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
করোনাভাইরাসে টালমাটাল পুরো বিশ্বে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পালস্না দিয়ে বাড়লেও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুস্থতার হারও ধাপে ধাপে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩১ মে পর্যন্ত পুরো বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬১ লাখ ৭২ হাজার ৪৪৮ জন এবং সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪ জন। এ হিসাবে গোটা বিশ্বে সুস্থতার হার ৪৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অথচ এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে সুস্থতার হার মাত্র ২০.৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে সুস্থতার হার বিশ্বের গড় সুস্থতার হারের অর্ধেকের চেয়েও কম। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, গত ৩ মে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা হঠাৎ ১৭৭ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৬৩ জন দেখানো হয়। সে অনুযায়ী ওই সময় দেশে করোনায় সুস্থতার হার দাঁড়ায় ১১.২৪ শতাংশ। আর ওইদিন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সুস্থতার হার ছিল গড়ে ৩২.১৬ শতাংশ। পরবর্তী ২৮ দিনে অর্থাৎ ৩১ মে পর্যন্ত দেশে সুস্থতার হার বেড়েছে ৯.৫ শতাংশ। অথচ একই সময়ে গোটা বিশ্বে গড়ে সুস্থতার হার বেড়েছে ১২.২৯ শতাংশ। অর্থাৎ এ পালস্নাতেও দেশ বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের দেওয়া পরিসংখ্যান চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি দেশের মধ্যে ১৬টি দেশের সুস্থতার হারও বাংলাদেশের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি। ৩১ মে পর্যন্ত বিশ্ব করোনা তালিকার প্রথম স্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৮৯৭ জন এবং সুস্থ রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ জন। অর্থাৎ সুস্থতার হার ২৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। একই সময় ব্রাজিলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৬ জন এবং সুস্থতার সংখ্যা ২ লাখ ৫ হাজার ৩৭১১ জন। এ হিসেবে সুস্থতার হার ৪১ দশমিক ০৭ শতাংশ। এছাড়া টপ টুয়েন্টিতে নিম্নক্রমে থাকা দেশগুলোতে সুস্থতার হার ছিল রাশিয়ায় ৪২.৩৫ শতাংশ, স্পেনে ৬৮.৭৯ শতাংশ, ইতালিতে ৬৬.৮৯ শতাংশ, ফ্রান্সে ৩৬.১৯ শতাংশ, জার্মানিতে ৯০.১২ শতাংশ, ভারতে ৪৭.৬৬ শতাংশ, তুর্কিতে ৭৭.৮৫ শতাংশ, পেরুতে ৪০.৭৩ শতাংশ, ইরানে ৭৮.৪৩ শতাংশ, চিলিতে ৪২.৬২ শতাংশ, কানাডায় ৫৩.৩৩ শতাংশ, মেক্সিকোতে ৭০.৭০ শতাংশ, চীনে ৯৪.৩৪ শতাংশ, সৌদিতে ৭০.৬১ শতাংশ, পাকিস্তানে ৩৬.৩৬ শতাংশ, বেলজিয়ামে ২৭.১০ শতাংশ, কাতারে ৪৬.৭৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সুস্থতার তুলনায় বাংলাদেশের সুস্থতার হারের নাজুক চিত্রটিই দেশে কোভিড নিয়ে জনগণের সচেতনতা ও সংবেদনশীলতার মাত্রাকে প্রমাণ করে। একই সঙ্গে করোনায় আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত সে বিষয়টিও এখন স্পষ্ট। এদিকে আক্রান্তের শীর্ষে থাকা দেশগুলোতে সংক্রমণের তৃতীয় মাসে গিয়ে পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ হতে দেখা গেছে। সংক্রমণের এ গতি-পরিধি বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আশঙ্কা, দেশে আক্রান্তের সংখ্যা আগামী কয়েকদিনে আরও হুহু করে বাড়বে। ফলে বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সীমিত সংখ্যক কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এতে সুস্থতার হার যেমন কমবে, তেমনি মৃতের সংখ্যা বাড়বে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে মোট আক্রান্তের ৯৯ দশমিক ৯০ ভাগই আক্রান্ত হয় দ্বিতীয় মাসে। একই সময়ে ইতালিতে এ হার ছিল ৯৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, স্পেনে ৯৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৯৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তৃতীয় মাসে। প্রথম দুই মাসের তুলনায় তৃতীয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৯৭ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যে ৮৫ শতাংশ রোগী বেড়েছিল। স্পেনে এটি ছিল ৫৫ ও ইতালিতে ৫৪ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৮৩ দিন পার করেছে। এতে সামনে দিনগুলোতে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো সংক্রমণের হার বাড়লে এবং এ সময় দেশে করোনা চিকিৎসার দ্রম্নত সম্প্রসারণ করা না গেলে সুস্থতা ও মৃতের পরিস্থিতি কোনদিকে গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে দেশে করোনা রোগীদের সুস্থতার হারের এ নাজুক দশা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা বলছে, প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে। এরা সুস্থ হওয়ার পর সে তথ্য সরকারকে দিচ্ছে না। আবার অনেককে বাড়ির ঠিকানায় পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সুস্থ হওয়ার একটা বড় সংখ্যা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এ কারণে আপাত দৃষ্টিতে সুস্থতার হার কম মনে হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতেও সুস্থতার হার তৃতীয় মাসের পর বেড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, 'মৃদু উপসর্গ নিয়ে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে। যারা অল্প সময়ের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠছে। অথচ সে তথ্য আমরা পাচ্ছি না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের সুস্থ হওয়ার তথ্য দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে এখানে একটি বড় গ্যাপ রয়েছে। তিনি আরো জানান, সুস্থ হয়ে ওঠার পর একবার ও সাত দিনের ব্যবধানে আরেকবার টেস্ট করার নিয়ম। এদের বেশিরভাগই দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করছে না। অনেক সময় তাদের বাড়ির ঠিকানায় গেলে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া শনাক্ত প্রকাশ হওয়ার ভয়ে অনেকে গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছে। এখানেও তথ্যের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, 'আমার মনে হয় কোথায় একটা ঝামেলা হচ্ছে। তা না হলে আক্রান্ত ও মৃতু্যর অনুপাতে সুস্থ হওয়ার হার এত কম হওয়ার কথা নয়। বাড়িতে বসে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে ও নেগেটিভ হচ্ছে, সে তথ্যটা সরকারের কাছে ঠিকমতো আসছে না। অনেকে নেগেটিভ হওয়ার পর দ্বিতীয়বার আর পরীক্ষা করছে না। এতে হয়তো গ্যাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এসব মতের সঙ্গে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অনেকেই একমত নন। তাদের ভাষ্য, চিকিৎসা সেবার দুর্বলতার কারণেই রোগীর সুস্থতার হার কম। অথচ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জনসচেতনতা না বাড়ায় রোগীর সংখ্যা উচ্চ হারে বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং করোনা মোকাবিলায় সরকারের গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হেলথ সার্ভিসের দুর্বলতার কারণে রোগীদের সুস্থ হতে দেরি হচ্ছে। ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না। সবাই ঠিকমতো কাজ করছে না। করোনার যে চিকিৎসা, তা রোগীরা ঠিকমতো পাচ্ছে না। শুধু হাসপাতালে নিয়ে শুইয়ে রাখলেই হবে না। চিকিৎসা দিতে হবে। অক্সিজেন পাচ্ছে না। ভেন্টিলেটর নেই; খাবার পাচ্ছে না। ফলে রোগীদের সুস্থ হতে সময় লাগছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ এক চিকিৎসক বলেন, দেশের বেশিরভাগ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে না মানা, আইসিইউগুলোতে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার অভাব এবং রোগীর বিভিন্ন জটিলতায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার বিষয়টি এ দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা ও যথাযথ নজরদারির অভাবকে স্পষ্ট করে তুলেছে। এই চিকিৎসকের আক্ষেপ, চীনে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জানার পর আমরা তিন মাস সময় পেয়েছি। এ সময় বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছুটা হলেও উন্নয়ন করা সম্ভব ছিল। এছাড়া লকডাউনও যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হতো তাহলে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব ছিল। অথচ এসব কোনো দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আর এসব কারণেই দেশে রোগীর সুস্থতার হার কম। এদিকে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উচ্চ হারে বৃদ্ধি এবং সে তুলনায় সুস্থতার হার কম হওয়ায় গত ২৪ মে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের আলাদা চিকিৎসা দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে নির্দেশ দিয়েছে। তবে তাতে সুস্থতার হার কতটা বাড়বে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, মেডিকেল কলেজ ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের পৃথক করোনা ইউনিট করার যে তাগিদ দেওয়া হয়েছে, তাতে হিতে বিপরীত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। নন-কোভিড ও কোভিড ইউনিটের জন্য শুধু পৃথক ভবন বা শয্যার ব্যবস্থা করলেই হবে না। এর জন্য পৃথক চিকিৎসক-নার্স ও মেডিকেল টেকনিশিয়ানের অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হবে। যা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এ জন্য অন্তত এক মাস সময় লাগবে। অথচ এর আগেই বিপুলসংখ্যক রোগীর প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ও চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। এ ব্যাপারে আরও আগে পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি ছিল বলে মনে করেন দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।