প্রস্তুতিহীন তদারকিতে স্বাস্থ্যবিধি উধাও

প্রকাশ | ০২ জুন ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
করোনাভাইরাস
করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ডজনখানেক নির্দেশনা দিয়ে ৩১ মে থেকে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট ও শিল্প-কারখানা খুলে দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে ৩১ মে ও ১ জুন থেকে সারাদেশে সীমিত আকারে বাস-লঞ্চ-ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহণ চলাচলেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানারও বিধান রয়েছে। অথচ সরকারি এসব নির্দেশনা কারা, কীভাবে তদারকি করবেন, তাদের সে সক্ষমতা আছে কি না, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কীভাবে এর সমন্বয় করবে তার কোনো পরিকল্পিত ছক নেই। ফলে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, মার্কেট-শপিংমল, গণপরিবহণ-পথঘাট সবখানে জনগণের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। স্বল্পসংখ্যক সচেতন মানুষ নিজ উদ্যোগে সতর্ক থাকার চেষ্টা করলেও বিপুলসংখ্যক বেপরোয়া মানুষের ভিড়ে তারাও যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আশঙ্কা, সারাদেশে ব্যক্তি পর্যায় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার যে ভয়াবহ প্রবণতা, তাতে মুষ্টিমেয় মানুষের সতর্ক থাকার চেষ্টাও পুরোপুরি ভেস্তে যাবে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও স্বল্প সময়ের মধ্যে করোনা মহামারির রূপ নেবে। এছাড়া ঘনবসতি ও দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে মৃতু্যর হারও উদ্বেগজনক হারে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ এক চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, রোববার (৩১ মে) থেকে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গণপরিবহণ সচল হওয়ার পর কোথায়, কে, কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে, তা ঘরের বাইরে পা রাখা সবাই সরাসরি প্রত্যক্ষ করছে। ঈদের আগে মার্কেট-শপিংমল খুলে দেওয়ার পর সেখানে কী ঘটেছে, ঈদের আগে মানুষে কীভাবে গাদাগাদি করে গ্রামে ফিরেছে এবং পরে তারা কীভাবে কর্মস্থলে এসেছে তা কারও অজানা নয়। তাই এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি তদারকির জন্য সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে তারা কেন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলে তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসকের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতি চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে ভীতির সঞ্চার করেছে। তাদের আশঙ্কা, সারাদেশে অঘোষিত লকডাউন তুলে নেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা যেভাবে উধাও হয়ে গেছে তাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশে করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা লাখের কোটা ছাড়িয়ে যাবে। যাদের সামাল দিতে গিয়ে তারাও ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এদিকে ঈদের আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেচাকেনার কারণে বিপুলসংখ্যক দোকান মালিক ও কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় এবার তারাই চান ক্রেতা-বিক্রেতার কেউ মাস্কবিহীন থাকলে, সামাজিক দূরত্ব না মানলে কিংবা হাঁচি, কাশি ও জ্বর নিয়ে দোকানে গেলে তাকে জরিমানার আওতায় আনা হোক। একই সঙ্গে এ বিষয়টি যেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কঠোর তদারকিতে থাকে তারও দাবি জানান তারা। অথচ রাজধানীর মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন দোকানপাটে ক্রেতা-বিক্রেতার স্বাস্থ্যবিধি তদারকির দায়িত্বে থাকা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এ ব্যাপারে তাদের অসামর্থ্যের কথা আগেভাগেই স্বীকার করেছে। দুই সিটি করপোরেশনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে মূল দায়িত্ব পালন করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু সরকার স্বাস্থ্যবিধি পালন করে দোকানপাট খোলার যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটি পালিত হচ্ছে কি না তা শুধু সিটি করপোরেশনের পক্ষে তদারকি করা সম্ভব হবে না। কারণ করপোরেশনের সে জনবল নেই। তবে তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি তদারকিতে তারা কাজ করছেন। এদিকে দোকানপাট খোলার বিষয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপনে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- হাটবাজার, দোকানপাটে ক্রয়-বিক্রয়কালে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। শপিংমলের প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শপিংমলে আসা যানবাহনগুলোকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাটবাজার, দোকানপাট এবং শপিংমলগুলো আবশ্যিকভাবে বিকাল ৪টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় সোয়া ৫ লাখ দোকানপাট রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে রয়েছে দুই লাখ ৪৩ হাজার। এই বিপুলসংখ্যক দোকানপাট এক সঙ্গে তদারকি করার কোনো সামর্থ্য বা প্রস্তুতি সিটি করপোরেশনের নেই। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, 'সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটি দোকানপাট যেহেতু সিটি করপোরেশন থেকে লাইসেন্স নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে সেহেতু সেগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আমাদেরও আছে। কিন্তু আমাদের যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি পালন করে দোকানপাট পরিচালিত হচ্ছে কি না সেটা তদারকি করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের যেসব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন তারা মাঠে রয়েছেন এবং কাজ করছেন। কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া আমাদের আর কোনো প্রস্তুতি নেই।' গত রোববার থেকে দোকানপাট খুলে দেওয়ার পর ক্রেতা-বিক্রেতারা অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেনাকাটা করছেন এবং বেশিরভাগ মার্কেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে স্বীকার করেন সিটি করপোরেশনের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এদিকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ১২ দফা নির্দেশনা মানতে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে সোমবার থেকে গণপরিবহণ চলাচল শুরু হলেও এ খাত তদারকিতেও তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। ফলে প্রথমদিন থেকেই পরিবহণ শ্রমিক ও যাত্রী সাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন গণপরিবহণ যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার সিটি সার্ভিসের বাসগুলোতে তেমন ভিড় না থাকলেও পরিবহণ শ্রমিকরা আগের মতোই টেনে টেনে বাসে যাত্রী তুলছেন। অধিকাংশ পরিবহণে নেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক স্প্রে; বাস স্টেশন ও স্টপেজগুলোতে নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। যাত্রী, চালক, সহকারী, কাউন্টারের কর্মী সবার জন্য মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক হলেও তা মানছে না অনেকেই। ট্রিপের শুরুতে এবং শেষে বাধ্যতামূলকভাবে গাড়ির অভ্যন্তরভাগসহ পুরো গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করার কথা থাকলেও তা মানার বালাই নেই। অথচ দিনভর রাজধানীর কোথাও কোনো তদারকি টিমের দেখা মেলেনি। যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ট্রাফিক বিভাগকে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার জোরাল নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ডিএমপির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ব্যাপারে তারা এখনো পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এছাড়া মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে গণপরিবহণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধিগুলো প্রণয়ন করা যাবে কি না তা নিয়েও তারা সন্দিহান। এ জন্য গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের খাতের নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে নগর সার্ভিসের এবং আন্তঃজেলা পরিবহণের যে বিপুলসংখ্যক বাস চলাচল করে তার শ্রমিক কর্মচারী ও যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না তা তদারকির জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সীমিত তৎপরতায় তা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা অনেকটাই অসম্ভব। এজন্য যাত্রীদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মনে করেন তিনি। এদিকে এ প্রসঙ্গে এআইজি মিডিয়া সোহেল রানা বলেন, সীমিত আকারে যানবাহন চলাচলের সুযোগ রেখে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই প্রজ্ঞাপনে কয়েকটি বিষয়ে জনসংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার বাস্তবায়ন ও প্রতিপালন সরকারের কয়েকটি সংস্থার দায়িত্বের আওতাধীন। বাংলাদেশ পুলিশও এ সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টসহ পুলিশের দায়িত্বের পরিসীমার মধ্যে পড়ে এরকম প্রতিটি বিষয়ে পুলিশ বরাবরের মতো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করবে এবং বাস্তবায়ন করবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি ভেঙ্গে গণপরিবহণ চলাচলের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথাও কোনো তৎপরতা চালিয়েছে এ ধরনের কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কেউ দিতে পারেননি। অন্যদিকে পুলিশের এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা যাত্রীদের করো কাছ থেকেও শোনা যায়নি। এদিকে সরকারি নির্দেশনা মেনে লঞ্চ চলাচলের বিষয়টি তদারকির জন্য চাঁদপুর, বরিশালসহ বেশকিছু জেলা শহরে স্থানীয় প্রশাসন সাময়িক তৎপরতা চালালেও তা পরিচালনা ছকে ব্যাপক ফাঁক থাকায় স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা ফলপ্রসূ হয়নি। নৌপথে চলাচলকারী বেশকিছু লঞ্চে গাদাগাদি যাত্রী পরিবহণ করা হয়েছে। সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা ও টিকিট সংগ্রহের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধিও মানা হয়নি বলে যাত্রীদের কাছ থেকে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনেকে এ অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে সরকারি ও করপোরেট কিছু অফিস স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও তদারকি না থাকায় বেশিরভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। মতিঝিল, গুলশান, উত্তরা ও ধানমন্ডিসহ রাজধানীর বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসন ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে ঢোকার মুখে হ্যান্ডহেল্ড থার্মোমিটার দিয়ে আগতদের তাপমাত্রা পরীক্ষা কিংবা হাত জীবাণুনাশক করার ব্যবস্থা নেই। কমন টয়লেটগুলো আগের মতো অপরিচ্ছন্ন। বয়স্ক ও অসুস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি দেওয়ার নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না ব্যক্তিমালিকানাধীন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। অথচ এসব বিষয় কারা তদারকি করবে, স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্ট এবং অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব কতটুকু তা-ও এখনো অনেকেরই অজানা। ফলে স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের নানা চিত্র দেখেও সচেতন অফিস কর্মীদের অনেকেই এ ব্যাপারে কারও কাছে অভিযোগ জানাতে পারছেন না।