পোশাকশিল্পে শ্রমিক ছাঁটাই

অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২০, ০০:০০

হাসান আরিফ
কর্মরত কয়েকজন পোশাকশ্রমিক -ফাইল ছবি
দেশের রপ্তানি আয়কে বছরের পর বছর প্রায় এককভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তৈরি পোশাক খাতে দেখা দিয়েছে করোনা মন্দা। একে মহামন্দা হিসেবেও অনেকে দেখছেন। এরই মধ্যে দেশের পোশাক খাতের রপ্তানি আদেশ ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এর প্রভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে এই খাতের মালিকপক্ষ। এই অবস্থায় সরকার আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। যা বাস্তবায়ন অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ধারণা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সূত্র জানিয়েছে, পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। সংগঠনের নেতাদের কেউ কেউ আবার শ্রমিকসংখ্যা ৪২ লাখ বলেও ুদাবি করেন। করোনার প্রভাবে দেশের পোশাক কারখানার কাজ এরই মধ্যে ৫৫ শতাংশ কমেছে। এমন অবস্থায় জুন থেকেই শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হবে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে তিনি এই ঘোষণা দেন। তবে তার এই ছাঁটাই প্রক্রিয়ার বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান। তিনি এই কথা কি করে বলেছেন তাও তার জানা নেই। আর শুধু ওভেন না নিট ফ্যাক্টরিসহ বলেছেন তাও তার অজানা বলে জানান। ফজলুর রহমান বলেন, আগামী ছয় মাস কঠিক সময় যাবে। এ সময়ে টিকে থাকার জন্য সমন্বিতভাবে করণীয় ঠিক করতে হবে। এজন্য সব পক্ষ নিয়ে একসাথে বসতে হবে। আর কোনো অবস্থাতেই কারখানা বন্ধ করা যাবে না বলেও তিনি মনে করেন। তার মতে, কারখানা বন্ধ করলে ভালো সময়ে কাজ ধরা সম্ভব হবে না। কারণ এই করোনা মহামারির কারণে কারখানা বন্ধ করলে ভালো সময়ে ভালো শ্রমিকও পাওয়া যাবে না। আর বন্ধ কারখানাকে কেউ কাজও দিবে না। তাই টিকে থাকতে কারখানা চালু রাখার বিকল্প নেই বলেও তিনি মনে করেন। আর প্রতিটা কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের মতো করেই তাদের শ্রমিকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে বলেও তিনি বলেন। এজন্য সমন্বিত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। নারী শ্রমিকদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাক খাতে নারীরা আবারও পিছিয়ে যাবেন বলে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমনিতেই বেশ কয়েক বছর ধরে এই খাতে নারী শ্রমিক কমে যাচ্ছে। নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা এখন বেশি। অথচ দেশে তৈরি পোশাক কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা দুইই বেড়েছে। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, পোশাকশিল্প খাতে পুরুষ এখন ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ; বিপরীতে নারী আছেন ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তি ও দক্ষতায় ঘাটতি, বেতন বাড়ায় পুরুষদের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকরা পিছিয়ে পড়ছেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের দক্ষ করতে তেমন উদ্যোগ না থাকার ফলেই নারীরা পিছিয়ে পড়েছে। কয়েক যুগের এই পেশা টিকিয়ে রাখা ছাঁটাইয়ের খড়্‌গ এখন নারীদের ওপরই পড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরএমজি খাতে মন্দা দেখা দিলে অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর এই খাতের শ্রমিক ছাঁটাই হলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত হতে পারে। দেশে এমনিতেই বেকারের সংখ্যা অনেক। তার সাথে নতুন করে কর্মহীন মানুষ যোগ হলে তাতে অস্থিরতা তৈরি হবে। এতে সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন হবে না। ফলে প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিবে। যা আগামী অর্থবছরের জিডিপিতে প্রভাব ফেলবে। চলতি অর্থবছরে এমনিতেই নেতিবাচক ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। এদিকে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ, এডিপিসহ প্রায় সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে এ বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋুাত্মক পর্যায়ে চলে যাবে। এশিয়ায় অনেক দেশই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে চলে যাবে। তবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশ অর্জিত হবে বলে সংস্থাগুলো থেকে জানানো হয়েছে। যদিও সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। সরকারের অর্থমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরাও বলেছেন, প্রবৃদ্ধি আটের কাছাকাছি থাকবে। এদিকে চলতি মাসের ১১ তারিখ নতুন বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। তার নতুন বাজেটেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা রেখে বাজেট দিতে যাচ্ছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও তিনি ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন বলে জানা গেছে। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, করোনা মন্দার কারণে অন্যান্য অর্থবছরের তুলনায় এইবারের বাজেটের আকার বৃদ্ধির হার কম। তারপরও নতুন বাজেট পুরানো বাজেটের থেকে বড় হবে। তাই আগামী বাজেটের মোট সম্ভাব্য আকার হতে পারে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেটে এডিপির আকার ইতোমধ্যে অনুুমোদন করা হয়েছে ২ কোটি ৫১ হাজার ৪৫ কোটি টাকার। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে এ বাজেট তিনি উপস্থাপন করবেন। বাজেট পাস হবে জুনের শেষে এবং বাস্তবায়ন হবে ১ জুলাই থেকে। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট একটা সংকটকালীন বাজেট। এজন্য নতুন বাজেটে জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষার উদ্যোগ প্রতিফলিত হতে হবে। উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে, জিডিপির লক্ষ্যকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং মানুষের জীবন রক্ষার জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে সারাবিশ্বই এখন বিপর্যস্ত। ফলে জিডিপি কী হলো তা এখন গুরুত্বপূর্ণ না। মানুষের কল্যাণে কী করা হবে তাই গুরুত্বপূর্ণ।