বুড়িগঙ্গায় লঞ্চের ধাক্কায় লঞ্চডুবি, ৩২ জনের লাশ উদ্ধার

ঘাটে ভেড়ার আগেই সব শেষ

প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে সোমবার সকালে এক লঞ্চের ধাক্কায় আরেকটি ছোট লঞ্চ ডুবে অন্তত ৩২ জনের মৃতু্য হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থল থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করেন -যাযাদি
ঢাকার শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক লঞ্চের ধাক্কায় আরেকটি ছোট লঞ্চ ডুবে অন্তত ৩২ জনের মৃতু্য হয়েছে। দুর্ঘটনা কবলিত এমভি মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট টারমিনালের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। ঘাট থেকে মাত্র ২০০ হাত দূরে। নামার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন যাত্রীরা। ঠিক তখনই অপর একটি লঞ্চ পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চটি উল্টে তলিয়ে যায়। ওই লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল। সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শ্যামবাজারের কাছে নদীতে চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা রোজিনা ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার পর তাদের ডুবুরিদল ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। পাশাপাশি নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, নৌ-পুলিশ ও বিআইডবিস্নউটিএ'র কর্মীরাও সেখানে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থল থেকে ৩২টি মৃতদেহ উদ্ধার করেন। এছাড়া স্থানীয়রা আরও দুজনকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন বলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার জানান। বিআইডবিস্নউটিএ'র পরিবহণ পরিদর্শক মো. সেলিম জানান, মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ডে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই ভেতরে আটকা পড়েন। তবে ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর-২ ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লালকুঠী ঘাটে যাত্রী নামিয়ে সদরঘাটের চাঁদপুর ঘাটে গিয়ে নোঙর করার জন্য ব্যাক গিয়ারে ঘুরছিল। ওই সময় পেছনে নদীতে থাকা এমভি মর্নিং বার্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন সোমবার বিকালে বলেন, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কাছাকাছি এলাকায় নদীর মাঝখানে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উল্টে রয়েছে। তাই ভেতরে কোনো মৃতদেহ আছে কিনা তা তলস্নাশি করা যায়নি। কথা ছিল তলস্নাশি শেষ হলে বিআইডবিস্নউটিএ'র উদ্ধারকারী নৌযান ডুবে যাওয়া লঞ্চটি টেনে তুলে সরিয়ে নেবে। কিন্তু বাবুবাজার ব্রিজের নিচ দিয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ 'প্রত্যয়' আসতে না পারায় তা সম্ভব হয়নি। এদিকে দুর্ঘটনার পর হাজার হাজার মানুষ ঘাটে এসে \হভিড় করেন। মর্নিং বার্ডের নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজে ঘাটে আসা স্বজনদের বিলাপ করতে দেখা যায়। সকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিস্নউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, দুই লঞ্চের কর্মীদের অসতর্কতায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন। তবে দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পৃষ্ঠা ২ কলাম ২ নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, একটি সিসিটিভি ফুটেজে যেভাবে ঘটনাটি দেখতে দেখা গেছে তাতে মনে হয়েছে ধাক্কা দেওয়ার বিষয়টি 'পরিকল্পিত'। এ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডবিস্নউটিএ'র পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে গঠিত এই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রাণ গেল যাদের দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা ওসি মোহাম্মদ শাহজামান জানান, যে ৩২ জনের লাশ মর্গে এসেছে, তাদের সবাইকে শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের সবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। তারা হলেন- শাহাদাত হোসেন (৪৪), আবু তাহের বেপারী (৫৮), সুমন তালুকদার (৩৫), ময়না বেগম (৩৫), তার মেয়ে মুক্তা আক্তার (১৩), আফজাল শেখ (৪৮), মনিরুজ্জামান মনির (৪২), গোলাপ হোসেন (৫০), সুবর্ণা বেগম (৩৮), তার ছেলে তামিম (১০), আবু সাঈদ (৩৯), সুফিয়া বেগম (৫০), শহিদুল ইসলাম (৬১), মিজানুর রহমান কনক (৩২), সত্য রঞ্জন বনিক (৬৫), শামীম বৈপারী (৪৪), বিউটি আক্তার (৩৮), আয়শা বেগম (৩৫), মো. মিলস্নাত (৩৫), মো. আমির হোসেন (৫৫), সুমনা আক্তার (৩২), পাপ্পু (৩২), মো. মহিম (১৭), দিদার হোসেন (৪৫), হাফেজা খাতুন (৩৮), হাসিনা রহমান (৩৫), সিফাত (৮), আলম বেপারী, তালহা (২), ইসমাইল শরীফ (৩৫), সাইফুল ইসলাম (৪২) ও বাসুদেব নাথ (৪৫)। নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি লাশ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন জানান। বিআইডবিস্নউটিএ'র পক্ষ থেকেও নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়ূর-২ লঞ্চটি জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তারা আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। উদ্ধার হওয়া মরদেহ মিটফোর্ডে রাজধানীর শ্যামবাজার এলাকাসংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মরদেহগুলো দুই দফায় রাজধানীর স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ডে) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক বুড়িগঙ্গা নদীতে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার পৃথক শোকবার্তায় এ মর্মান্তিক ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তারা। এ দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সবার প্রতি আহ্বানও জানান তারা। মির্জা ফখরুলের শোক বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবিতে ৩২ জনের মৃতু্যতে গভীর শোক ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। হতাহতদের প্রতি বিএনপির মহাসচিব শোক জানিয়ে বলেন, আলস্নাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন ও পরিবার শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করুন। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি দ্রম্নত উদ্ধারের দাবি জানান তিনি। লঞ্চ দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দাবি রাজধানীর সদরঘাটের অদূরে শ্যামবাজারে বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রীবাহী দুই লঞ্চের দুর্ঘটনায় হতাহতদের দ্রম্নত উদ্ধার, চিকিৎসা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ দাবি জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সরদঘাটের এপার থেকে ওপারে যাতায়াতে প্রায় ছোট ছোট দুর্ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এহেন ভয়াবহ দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। তিনি এহেন দুর্ঘটনা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি হতাহতদের দ্রম্নত উদ্ধার ও বিনামূল্যে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তিনি নিহতদের মরদেহ নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের খরচে প্রত্যেক পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং হতাহতদের পরিবারের কাছে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।