দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান

প্রকাশ | ০২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপায় কেলেঙ্কারি, দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র সাহাকে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অসহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়েই দ্রম্নত সময়ের মধ্যে তাকে বিদায় নিতে হচ্ছে। তার স্থানে বসানো হচ্ছে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলামকে। গত সপ্তাহের বুধবার এ সংক্রান্ত ফাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষর করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গেলেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। সূত্র জানায়, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, ভোকেশনাল ও মাদ্রাসার বই ছাপাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ পরিপন্থি উলেস্নখ করে হাইকোর্টে রিট করে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। রিটে বিবাদী করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, অর্থ সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও সচিব এবং দুদকের চেয়ারম্যানকে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৯ নভেম্বর আদালত বিবাদী প্রথম পাঁচজনকে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নিশ্চিত করতে দায়িত্বে অবহেলা এবং ভবিষ্যতে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক ছাপায় দুর্নীতি বন্ধে নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না; আর এনসিটিবির দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিগত বছরের টেন্ডারের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কেন তদন্ত করা হবে না- তা জানতে চেয়ে আদালত রুল জারি করে। দুদক সূত্র জানায়, আদালতের নির্দেশে গত ৮ জানুয়ারি দুদকের মহাপরিচালককে (বিশেষ তদন্ত) তদন্ত করার নির্দেশ দেয় কমিশন। দুদকের উপ-পরিচালক আলী আকবরকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু দুদকের এই তদন্ত কর্মকর্তাকে কোনো ধরনের তথ্য দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বরং এনসিটিবি কর্মকর্তাদের পক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য একটি চক্র চাপ দিচ্ছে। এনসিটিবির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৬৫ পাতার অভিযোগে বলা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক তৈরি ও মুদ্রণে এনসিটিবিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি, ছাপা ও বিতরণে ২০টি ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিতেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। এ কাজে জড়িত এনসিটিবির চেয়ারম্যান থেকে শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে দরপত্রদাতাদের আঁতাঁত রয়েছে। যে কারণে টেন্ডার সম্পর্কিত গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো কর্মকর্তার মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান আছে। বেনামে ওই প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজও পায়। টেকনিক্যাল কমিটিতে অযোগ্য হওয়ার পরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাপ দিয়ে কাজ দিতে বাধ্য করেন। কাজ পাওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মুদ্রণ যন্ত্র, বাঁধাই, লেমিনেটিং যন্ত্র ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী না থাকলেও দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে কাজ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, মুদ্রণ কাজের মান নিয়ন্ত্রণে এজেন্ট নিয়োগেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়। অর্থের বিনিময়ে নিম্ন মানের কাজগে বই ছাপার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কেনাকাটায় মানহীন প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহের অর্ডার দেওয়াসহ চার ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে পরিদর্শনের নামে প্রতি বছর অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। ২০১৮ সালে প্রাথমিক বই ছাপাতে সরকারকে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়। বছরটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছর। শেষ বছর হওয়ায় মুদ্রণকারীদের সিন্ডিকেট নির্ধারিত দরের ৩৫ শতাংশ কম দর দিয়ে টেন্ডার জমা দেয়। পুনঃদরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। তাতে আরও দর বাড়িয়ে দিয়ে সিন্ডিকেট বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর সঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যানসহ প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাদের মূল পদ সরকারি কলেজ হলেও এনসিটিবির স্থায়ী কর্মকর্তাদের পদ দখল করে আছেন। এছাড়াও উচ্চমাধ্যমিকের বই বাজারজাতের কাজেও কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। প্রকাশকরা আবেদন করলেই এনসিটিবি বইয়ের দাম বাড়িয়ে দেয়। গত বছর প্রকাশকদের পক্ষে বইয়ের দাম বাড়াতে কোনো প্রকাশক আবেদন করেনি। বই ছাপানো ও বাঁধাইয়ের উপকরণের দামও কম ছিল। এনসিটিবির রয়্যালটি বাড়ায়নি। তারপরেও চেয়ারম্যান বইয়ের দাম বাড়িয়ে দেন। এতে একটি প্রতিষ্ঠান এককভাবে অন্তত দুই কোটি এক লাখ ৬০ হাজার টাকা বেশি লাভ করেছে। দুদকের কাছে করা অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল নারায়ন চন্দ্র সাহা এনসিটিবির চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসার পর প্রকাশক ও মুদ্রাকরদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। নামে-বেনামে প্রচুর সম্পদ গড়েছেন। তার দুর্নীতির সহযোগী প্রতিষ্ঠানটির সচিব প্রফেসর মো. নিজামুল কবির। করোনার মধ্যে তিনি কোনা প্রকার অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। এই দুই মানিকজোড়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করছে দুদক। তবে অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন একজন কর্মকর্তা তদন্তের রিপোর্ট চেয়ারম্যানের পক্ষে দিতে তদবির করছেন। দুদকের পরিচালক ও উপ-পরিচালক পদে থাকা তার নিকট আত্মীয় দুইজনকে দিয়ে এ তদবির করাচ্ছেন। এনসিটিবির ওই কর্মকর্তাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। জানা গেছে, নারায়ন চন্দ্র সাহা আত্মীকৃত শিক্ষক। ১৯৮৬ সালে নরসিংদীর শহীদ আসাদ কলেজে প্রভাষক পদে চাকরিতে যোগ দেন। এরশাদ সরকারের আমলে কলেজটি সরকারিকরণ হয়। তৎকালীন আত্মীকরণের বিধিমালার কারণে তার বয়স নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এ সময়ে জালিয়াতি করে এসএসসি সার্টিফিকেটে তার বয়স কমানোর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। গত মার্চ মাসের আগেই কারিকুলাম চূড়ান্ত করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চেয়ারম্যানের উদাসীনতায় তা ভেস্তে গেছে। সম্প্রতি কারিকুলাম নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি চেয়ারম্যানকে ভর্ৎসনা করেন। শেষ পর্যন্ত নারায়ন চন্দ্র সাহাকে সরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠান শিক্ষামন্ত্রী। এসব অভিযোগের ব্যাপারে অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র সাহা যায়যায়দিনকে বলেন, দুদকের তদন্তে যত ধরনের সহযোগিতা দরকার সবই করা হচ্ছে। কোথায় অসহযোগিতা করেছেন সেটি তাদের স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, বই ছাপানো পুরো কাজটি একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়ে থাকে। যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিসহ আরও বেশ কয়েকটি সংস্থা জড়িত। এনসিবিটি বা কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে অনিয়ম করা সম্ভব না বলেও দাবি করেন তিনি। এদিকে, অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম ১৩তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তা। তিনি ক্রিকেটার ও এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজার চাচা। ফরহাদুল ইসলামের সহকর্মীরা জানান, তিনি একজন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে সর্ব মহলে পরিচিত। এর আগে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রকসহ গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার দক্ষতায় এ বছর সারাদেশে নির্ধারিত সময়ের আগেই বিনামূল্যের বই পৌঁছে দেওয়া হয়। চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিকের বই বাজারজাত করতে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতেও তৎপর রয়েছেন তিনি। ফরহাদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কিছু জানি না। সরকার আমাকে যে দায়িত্ব দিবে দক্ষতার সঙ্গে পালন করব।