উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন

বিতর্কের মুখে প্রাথমিকের ১৫০ কোটি টাকার বই কেনা স্থগিত

কমিটির কার্যপরিধি নিয়ে প্রকাশকদের প্রশ্ন বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বা দেড় গুণ বেশি দাম ধরা হয়েছে

প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০২০, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
বিতর্কের মুখে আটকে গেল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৫০ কোটি টাকার বই কেনার কার্যক্রম। সৃজনশীল প্রকাশক ও লেখকের আপত্তির মুখে বই কেনার প্রক্রিয়া স্থগিত করে দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। একই সঙ্গে বইয়ের বাজার মূল্য নির্ধারণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে টেন্ডার ছাড়াই প্রায় ৩১ কোটি টাকার বই কিনেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত একটি কমিটি হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলমকে আহ্বায়ক, যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) রুহুল আমিন ও উপসচিব (শৃঙ্খলা) আক্তারুন্নাহার সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে এসব বইয়ের বাজার মূল্যে ও ক্রয় প্রাইমারি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে হবে। তবে কমিটির একজন সদস্য করোনা পজিটিভ হওয়ায় অন্য কাউকে কো-অপ্ট করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে কমিটির একজন সদস্য বলেন, বৃহস্পতিবার কমিটি হলেও কমিটি রোববার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবেন। জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, আমি ঘটনা জানার পরে বই ক্রয়ের প্রক্রিয়া স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছি। বিধিলঙ্ঘন করে কিছু হয়েছে কিনা তা যাচাই করতে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গেছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে 'বঙ্গবন্ধু কর্নার' করে সেখানে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর শৈশব, রাজনৈতিক দর্শনসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই কেনার উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছর ৬৭টি বই কেনার ব্যাপারে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ৯টি বই কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। প্রতিটি বইয়ের ৬৫ হাজার কপি করে কেনা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ডিপিই অখ্যাত কিছু প্রকাশনীর অখ্যাত লেখকদের লেখা ৬৫ হাজার সেট বই ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন, যার মূল্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব বই সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ডিসেম্বরে প্রক্রিয়াটি শুরু করে। মন্ত্রণালয় থেকে শুধু বই কেনার অনুমতি নেওয়া হয়। কিন্তু কোন প্রকাশনীর ও কোন লেখকের বই কেনা হবে মন্ত্রণালয়ের কেউই বিষয়টি জানেন না। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেয়ে ডিপিই বই ক্রয় করার প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রথম দফায় এরই মধ্যে ৩১ কোটি টাকার বই কিনেছে। তবে বই কিনতে কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা তদন্ত কমিটি চাইনি। তারপরও যেহেতু হয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাই। তবে বই কেনার প্রক্রিয়া কীভাবে হলো, কাদের বই এভাবে ঢুকল তা যাচাই বাচাই করা হোক। তিনি বলেন, আমরা চাই বই কেনার প্রক্রিয়া যাতে সার্বজনীন হয়। এ ব্যাপারে পুস্তক প্রকাশন ও বিক্রেতা সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শ্যামল পাল যায়যায়দিনকে বলেন, বই কেনার সাধারণ যে রীতি তার কোনোটিই এখানে মানা হয়নি। কারণ জাতীয় গ্রন্থাগারসহ সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বই কেনার কমিটিতে আমাদের সমিতির সদস্য, দেশের নামকরা লেখকদের রাখা হয়। কিন্তু এখানে কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি, কোনো কমিটি করা হয়নি। তিনি বলেন, দ্রম্নত এ বিষয় সুরাহা হওয়া উচিত। একাধিক প্রকাশক যায়যায়দিনকে বলেন, যে কেনাকাটার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা জড়িত সেখানে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি কতটুকু স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারবে? তাছাড়া প্রতিটি বই বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বা দেড় গুণ বেশি দাম ধরা হয়েছে। যেটা মন্ত্রণালয়ের সচিব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অনুমোদন করেছেন। এ কমিটি এসব বিষয় তাদের বিষয়ে কী সুপারিশ করবে? এ ব্যাপারে পুস্তক প্রকাশন ও বিক্রেতা সমিতির (রাজধানী শাখা) সভাপতি মাজহারুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, কমিটির যে কার্যপরিধি দেওয়া হয়েছে তাতে আমাদের মূল দাবিগুলো প্রতিবেদনে আসবে কী না তা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, করোনার মধ্যে সব প্রকাশক যখন প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছি, সেখানে গুটিকয়েক অখ্যাত প্রকাশক ও লেখকদের বই কীভাবে কেনা হলো? পুরো প্রকাশনা শিল্পকে ধব্বংসের একটি চক্রান্ত বলে মনে করেন তিনি। বই ক্রয়ের তালিকায় দেখা গেছে, তালিকা স্থান পাওয়া বেশিরভাগ বই অখ্যাত প্রকাশনী ও লেখকের বই রয়েছে। বিষয়টি জানতে পেরে ক্রয় প্রক্রিয়াটি বাতিলের দাবি জানিয়ে খ্যাতনামা লেখকরা যথাযথভাবে বই ক্রয়ের আহ্বান জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন। তারা যাচাই-বাছাই করে বই ক্রয়ের আহ্বান জানান তারা। কিন্তু এরপরও বই বাতিল করা হয়নি ক্রয় প্রক্রিয়া। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ক্রয়ের তালিকায় ৩০টির মতো বই রয়েছে। প্রত্যেকটি বই ৬৫ হাজার কপি করে ক্রয় করা হবে। এতে ১৫০ কোটি টাকা সরকারের খরচ হবে। সরকারি দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশির ভাগই অখ্যাত প্রকাশনী থেকে অপরিচিত লেখকদের বই। অবৈধভাবে বই ক্রয়ের প্রক্রিয়া বাতিলের দাবি জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এবং সচিব বরাবর দুই দফা চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। গত ২২ জুন সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ও সমিতির রাজধানী শাখার সভাপতি মাজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রথম চিঠিটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী জাকির হোসেন বরাবর দেওয়া হয়। যার অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ডিপিই ডিজিকে দেওয়া হয়। তাদের দাবি, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে, বাছাই কমিটির মাধ্যমে বই নির্বাচন করার। চিঠিতে তারা দাবি করেছেন- একক শিরোনামের বই এত বিপুল সংখ্যায় না কিনে একই পরিমাণ অর্থে একাধিক শিরোনাম, লেখক ও প্রকাশকের বই কেনা যায়। এর ফলে করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগকালে বিপর্যস্ত প্রকাশকরা যেমন আশার আলো দেখতে পাবেন, বেশিসংখ্যক লেখকও তেমনি উপকৃত হবেন। সমিতির নেতারা চিঠির কোনো উত্তর না পেয়ে গত ২৮ জুন ফের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছেন। তাতে এ ক্রয় প্রক্রিয়ার দ্বিতীয়পর্যায় অবিলম্বে বাতিল করার আহ্বান জানান। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও করোনার কারণে পুরো টাকা খরচ করা সম্ভব হয়নি। ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে ২৫ কোটি টাকার বই কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বই কেনার তালিকায় আরও নতুন বইয়ের নাম যুক্ত হতে পারে। সূত্র বলছে, আগামী অর্থবছরে আরও বই কেনা হবে। সেখানে এ-সংক্রান্ত প্রকাশনা সংস্থার যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। চলতি বছর ৬৭টি বইয়ের মধ্যে ২২টি বই রয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির। এ ছাড়া বাংলা একাডেমির ১টি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২টি এবং সিআরআইসহ আরও কয়েকটি প্রকাশনার বই রয়েছে। যার মধ্যে আছে ইউপিএল প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে বই '৩০৫৩ দিন, এটি প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আগামী প্রকাশনীর বই 'শেখ মুজিব আমার পিতা', এটি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং 'বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান', সম্পাদনা করেছেন শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ; মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত 'বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা'; পাঠক সমাবেশ প্রকাশিত 'শেখ হাসিনা : নির্বাচিত উক্তি' বইগুলো রয়েছে। এ ছাড়া হাসুমণির পাঠশালা থেকে প্রকাশিত 'খোকা যখন ছোট্ট ছিলেন' বইটির ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়েছে।