দ্বিধায় করোনা রোগীরা

সুস্থতার সংজ্ঞা তিন দফা পরিবর্তন

সর্বশেষ সংজ্ঞার গাইডলাইন অনুসরণ করতে গিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
শনাক্তের চার মাসের মধ্যে করোনা রোগীর সুস্থতার সংজ্ঞায় তিনবার পরিবর্তন করেছে সরকার। সর্বশেষ সংজ্ঞার গাইডলাইন অনুসরণ করতে গিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ভাইরাসটির মিউটেশন বা রপান্তর প্রক্রিয়া ও অন্যান্য রোগের জটিলতায় ভোগা রোগীদের সুস্থ হতে আরও বেশি সময় লাগছে। ফলে করোনামুক্ত হলেও অন্যান্য রোগব্যাধি মাথা চাড়া দিলে পুনরায় ভর্তি হতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। আবার বারবার সংজ্ঞা পরির্তনের ফলে রোগীদের ছাড়পত্র দিতে বিপাকে পড়ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মার্চ মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুস্থতার প্রথম সংজ্ঞায় বলা হয়, কারও দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হলে ১৪-২১ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় পরীক্ষা করা হবে। দ্বিতীয়বার ফলাফল নেগেটিভ আসলে পরবর্তী ২৪-৭২ ঘণ্টার মধ্যে আরেক দফা পরীক্ষা করানো হবে। তৃতীয়বারেও ফলাফল নেগেটিভ আসলে রোগীকে সুস্থ ঘোষণা করা হবে। তবে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার সময় রোগীকে আরও ১৪ দিন বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এরপর রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় দ্বিতীয় দফায় ৫ মে সুস্থতার সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) স্বাক্ষরিত একটি চিঠি করোনা চিকিৎসা হাসপাতালসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়। চিঠিতে করোনা রোগীকে ছাড়পত্র দিতে পাঁচটি মাপকাঠির কথা উলেস্নখ করে বলা হয়, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ছাড়াই জ্বর কমে গেলে কাশি বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার উলেস্নখযোগ্য উন্নতি হলে এবং ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর দুটি আরটিপিসিআর পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হলে রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া যাবে। তবে কোনো কারণে পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে পরপর তিন দিন প্রথম দুটি শর্ত পূরণসাপেক্ষে রোগী ছাড়া পাবে। এ ছাড়া রোগীকে বাড়িতে বা সরকার নির্ধারিত স্থানে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে। আর সম্ভব হলে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে যা আগে হাসপাতালে রেখে করা হতো। সর্বশেষ ২৮ জুন তৃতীয়বারের মতো এই সংজ্ঞা পরিবর্তন এনে সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি পাঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, এখন থেকে পরপর তিনদিন রোগী করোনা উপসর্গবিহীন থাকলে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাবেন। পরপর ১০ দিন উপসর্গবিহীন থাকলে রোগীর করোনাভাইরাসমুক্ত ধরে নেওয়া হবে। তবে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে করোনায় আক্রান্ত একাধিক রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসা গাইডলাইনে সুস্থতার মানদন্ড নির্ধারিত হলেও অনেকের ক্ষেত্রে ২০ দিনেও শরীরে ভাইরাস অকার্যকর হচ্ছে না। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হলেও ভাইরাসটির মিউটেশন বা রপান্তর প্রক্রিয়া ও অন্যান্য রোগের জটিলতায় ভোগা রোগীদের সুস্থ হতে আরও বেশি সময় লাগছে। ফলে করোনামুক্ত হিসেবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অন্যান্য রোগব্যাধি মাথা চাড়া দিলে পুনরায় ভর্তি হতে বেগ পেতে হচ্ছে। এতে করে জরুরি মুহূর্তে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে কোমরবিডিটিসম্পন্ন রোগীর মৃতু্য পর্যন্ত হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে জনস্বাস্থ্যবিদরা যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীদের কাশি বা জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এ ছাড়া আক্রান্তের শরীরে ব্যথা, ক্লান্তি, গলাব্যথা এবং মাথাব্যথা হতে পারে। প্রথমদিকে কাশির ধরন শুষ্ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, বেশি পরিমাণে তরল খাদ্য গ্রহণ, বিশ্রাম ও ভিটামিন সি, ডি'র ঘাটতি পূরণের পরামর্শ দেন। তবে সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে মৃদু উপসর্গের অনেক রোগীর সুস্থ হতে ৩৭ দিন পর্যন্ত সময় লেগেছে। এ ছাড়া ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রনিক ডিজিজে ভোগা (দীর্ঘস্থায়ী রোগব্যাধি) ব্যক্তিদের করোনা সুস্থ হয়ে উঠতে গড়পড়তা দুই সপ্তাহ সময় লেগেছে। মূলত সুস্থ হয়ে ওঠার বিষয়টি রোগীর অসুস্থতার ওপর নির্ভর করায় অনেকে সামান্য উপসর্গ নিয়ে দ্রম্নত সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আবার অনেকের এটা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ভাইরোলজিস্ট) ডা. মোশতাক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, সংক্রমণ ও সুস্থতা বিবেচনায় এমন পরিবর্তন হতে পারে। তবে করোনা সারলেও কোমরবিডিটি'তে ভোগা রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি থাকায় অনেকের দীর্ঘ চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কারণ, সদ্যপ্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চিকিৎসার একপর্যায়ে করোনা নেগেটিভ আসলেও শরীরে ভাইরাসটির সংক্রমণের ফলে ইমিউনিটি সিস্টেম দুর্বল হয়ে যায়। পূর্বের রোগব্যাধি বেড়ে যাওয়ায় তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কাজেই ডবিস্নউএইচও'র নীতি অনুসরণ করে করোনামুক্ত হলেও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় সচেতন হতে হবে। এ জন্য রোগী ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হতে গিয়ে যেন ফিরে আসতে না হয়, সে ব্যাপারে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, উপসর্গ না থাকার ভিত্তিতে হাসপাতাল সুস্থতা ঘোষণার পর বাড়িতে দুই সপ্তাহ আইসোলেশনে থাকার বিষয়টি সঠিকভাবে মানতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী রোগের ইতিহাস থাকলে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হবে। যেহেতু অধিকাংশ রোগী কোমরবিডিটির জন্য মারা যাচ্ছেন। সরকারের উচিৎ, এই সংখ্যা কত, সেটির হিসাব করা। কোভিড- নন-কোভিড রোগীদের ট্রিটমেন্ট প্রটোকল দেওয়া। সুস্থতার মানদন্ডের ব্যাপারে রোগীদের স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক যায়যায়দিনকে বলেন, লক্ষণ দেখে সুস্থতার কথা বলা গেলেও টেস্ট ছাড়া ভাইরাসমুক্ত- এ কথা বলা সম্ভব না। অনেক সময় হাসাপাতালে রোগীর চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের উচিৎ, রোগীদের কল্যাণে সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুসরণ করা ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আকতার যায়যায়দিনকে বলেন, ডবিস্নএইচও ও বাংলাদেশের ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট কমিটির দেওয়া গাইডলাইন অনুসরণ করে করোনা-বিষয়ক কারিগরি কমিটি সুস্থতার মানদন্ড তথা সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। দেশের রোগতাত্ত্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা নিয়ে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের সেবা নিশ্চিত এবং বেশি অসুস্থ রোগীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হলেও বাড়িতে আইসোলেশন তথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে বলা হচ্ছে।