ট্যাক্সিচালক থেকে ভয়ংকর খুনি

বন্দুকযুদ্ধে নান্নু-মোশারফ নিহত শফিক ও সিদ্দিক গ্রেপ্তার

প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
রাজধানীতে রোববার রাতে ডিবি পুলিশ ছিনতাইকারী দলের দুই সদস্যকে আটক করে -যাযাদি
রাজধানীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা। এ চক্রের সদস্যরা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। সম্প্রতি শফিক, সিদ্দিক, নান্নু ও মোশারফ নামে এমনই একটি চক্রের চার সদস্যকে শনাক্তের পর গ্রেপ্তারে অভিযানে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের মধ্যে রোববার রাতে নান্নু ও মোশারফ ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। বাকি দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ও নিহতরা এক সময় হলুদ ট্যাক্সিক্যাব চালাতো। এই চক্রের আরও একাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছে। যাত্রীদের কাছ থেকে মালামাল ছিনতাইয়ের নেশায় তারা ভয়ংকর খুনি হয়ে ওঠে। সেই নেশা থেকেই সম্প্রতি তারা খুন করে বসে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারুন-অর-রশিদকে। এর আগে যাত্রী খুনের অপরাধে তারা অর্ধযুগ কারাবাসও করে বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (গুলশান) মশিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, এই চক্রের সদস্যরা ছিনতাইয়ের নেশায় ভয়ংকর খুনি হয়ে ওঠে। তারা এক সময় হলুদ ট্যাক্সিক্যাব চালাতো। ওই সময় যাত্রীদের জিম্মি করে ছিনতাই শুরু করে। এভাবে কিছুদিন চলার পর তারা এক যাত্রীকে খুন করে। সেই অপরাধে তারা ৬ বছর জেলও খাটে। জেল থেকে বের হওয়ার পর তারা আবারও পুরানো পেশায় ফিরে যায়। ট্যাক্সিক্যাব চালানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে শিকারের সন্ধানে নেমে পড়ে। করোনাকালে তারা রাতে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ঘোরাফেরার এক পর্যায়ে যাত্রীদের জিম্মি করে টাকা-পয়সা কেড়ে নিত। গত মাসের ১৭ তারিখে তারা সিএনজির যাত্রী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারুন-অর-রশিদকেও একইভাবে জিম্মি করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তাকে চোখে মলম দিয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে খুন করে। পরে হারুন-অর-রশিদের লাশ ফেলা হয় তিনশ ফিট এলাকায়। এই চক্রের আরও একাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জানা গেছে, সম্প্রতি মহাখালী, খিলক্ষেত ও কুড়িল বিশ্বরোড ফ্লাইওভারের আশপাশ এবং পূর্বাচলগামী তিনশ ফিট এলাকায় অজ্ঞান, মলম ও গামছা পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। পাশাপাশি সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে থাকা যাত্রীবেশী দুর্বৃত্তরাও মাঝে মাঝে ছিনতাই, ডাকাতি ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছিল। এর আগে এ ধরনের অপরাধীদের একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হলেও এই চক্রের সদস্যদের উৎপাত কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা পুলিশের রাতের ডিউটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরই মাঝে রোববার রাতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সিএনজি অটোরিকশায় এই চক্রের সদস্যরা ঘোরাফেরা করছে বলে খবর আসে। এমন খবরের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশানের ডিসি মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম খিলক্ষেতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে একটি সিএনজি অটোরিকশাকে শেওড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিগন্যাল দিলে তারা অমান্য করে খিলক্ষেত ফ্লাইওভারের দিকে যেতে থাকে। পুলিশও তাদের পিছু নেয়। এক পর্যায়ে বিশ্বরোড ফ্লাইওভারের নিচে ময়লার ডিপোর সামনে এসে তারা সিএনজি থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশও তাদের পিছু নিলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়লে দুজন আহত হয়। আহত অবস্থায় সিএনজি অটোরিকশার ভেতর থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত বলে জানান। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র, গুলি, মলম, গামছা ও রক্তমাখা চাপাতি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জুনায়েদ আলম সরকার যায়যায়দিনকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে অপর গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে- শফিকুল ইসলাম ও সিদ্দিক। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানায়, নিহতদের একজনের নাম নান্নু অপরজনের নাম মোশারফ। নান্নু এক সময় হলুদ ট্যাক্সিক্যাব চালাতো। ট্যাক্সিক্যাবের যাত্রীকে হত্যার অভিযোগে সে ৬ বছর জেল খেটেছে। নিহত মোশারফও একাধিক মামলায় সাজা ভোগ করেছে। গ্রেপ্তারকৃত ড্রাইভার শফিক ও সহযোগী সিদ্দিক এর আগেও একাধিকবার ইয়াবা এবং ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছে। তারা সবাই এক সময় ট্যাক্সিচালক ছিল। সেখান থেকেই তাদের ছিনতাই ও খুনের হাতেখড়ি। করোনাকালে তারা সিএনজি অটোরিকশায় যাত্রী পরিবহণের নামে ছিনতাই করে আসছিল। মহাখালী, বনানী, আমতলী, সৈনিক ক্লাব থেকে যাত্রী নেওয়ার পর রাস্তায় কৌশলে সিএনজি বন্ধ করে দিত। এরপর পাশ থেকে আরও কয়েকজন সিএনজিতে উঠে বসতো। পরে তারা যাত্রীর অন্ডকোষ চেপে ধরে, চোখে মুখে মলম দিয়ে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দিত। এতে অনেক সময় যাত্রী অন্য যানবাহনের নিচে চাপা পড়ে মারা যেত। আবার অনেক সময় যাত্রী প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তাকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যার পর লাশ পূর্বাচলগামী তিনশ ফিট রাস্তা অথবা তুরাগ থানাধীন দিয়াবাড়ি বেড়িবাঁধ এলাকায় ফেলে দিত। এই চক্রের সদস্যরাই গত ১৭ জুন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারুনকে আমতলী থেকে যাত্রী হিসেবে উঠিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটাল পার হওয়ার সময় কিল-ঘুসি মেরে চোখে মলম লাগিয়ে দেয়। হারুন প্রতিরোধ করতে চাইলে তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে নান্নু এবং মোশারফ জোরে টানতে থাকে। একপর্যায়ে হারুনের নাক কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে মারা গেলে তার লাশ তিনশ ফিট এলাকার অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পাশে ফেলা দেওয়া হয়। উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, 'হারুনের ঘটনায় তদন্ত নেমে বেশ কিছু সমস্যা সামনে এসেছে। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা- রাতে অধিকাংশ সড়কে আলোকস্বল্পতা দেখা গেছে। আবার অনেক স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানো থাকলেও সেগুলো নষ্ট অবস্থায় রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সড়কে ঘটে যাওয়া অপরাধ শনাক্তে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এ দুটি বিষয় সবার সামনে আসে। এছাড়া ফ্লাইওভারের বাতিগুলোও কিছু কিছু স্থানে নষ্ট রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অপরাধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব অপরাধ ঘটছে রাতের বেলায়। এর আগেও মলম ও টানা পার্টির দৌরাত্ম্য ছিল। তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। আশা করা যায় দ্রম্নতই তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।'