স্বাস্থ্য খাতের 'গডফাদার' কে এই মিঠু

প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু
স্বাস্থ্যখাতের যেকোনো অনিয়মের গোড়া খুঁজতে গেলেই অবধারিতভাবে চলে আসে মিঠু সিন্ডিকেটের নাম। সিন্ডিকেটের এই মিঠু হলেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। স্বাস্থ্যখাতের সর্বত্র তার অদৃশ্য জাল ছড়ানো। প্রায় তিন দশক ধরে বিছানো এই জাল দিনে দিনে আরও পোক্ত হয়েছে আর হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বরাবরেই মতোই আড়ালে থাকা মিঠু। অভিযোগ আছে, এখনো তার অঙ্গুলি হেলানো ছাড়া স্বাস্থ্যখাতে কোনো কেনাকাটা হয় না। করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতের যখন টালমাটাল অবস্থা, একের পর এক প্রকট হয়ে উঠছে অব্যবস্থাপনা আর অনিয়ম, তখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে মিঠু সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরো স্বাস্থ্যখাতে বিস্তৃত মিঠুর জাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা বু্যরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদপ্তর, প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। তারা মিঠুর হয়ে কাজ করে। স্বাস্থ্যখাতে মিঠু মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত। মিঠু বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকেন। বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্যখাত। বিদেশেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ন্ত্রণে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটান। কখনো তা অর্থের মাধ্যমে, আবার কখনো হুমকি-ধামকির মাধ্যমে। মিঠুর সিন্ডিকেটের মর্জিমতো কাজ না করে উপায় নেই- বলছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি হাসপাতালের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। কারণ, এই সিন্ডিকেটের লুটপাটসহ নানা রকমের অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে অনেক উচ্চ পর্যায়ের যোগসাজশ রয়েছে। টেন্ডার কারসাজিতে পটু এই সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে সরকারি সিনিয়র পর্যায়ের ডাক্তার, প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাড়াও বাইরের কিছু দালাল ব্যবহার করে। এরা সরকারি যে হাসপাতাল বা যে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সেই হাসপাতালের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আগেই বোঝাপড়া করে নেয়। টেন্ডার যেভাবেই আহ্‌বান করা হোক না কেন, যে বা যারাই টেন্ডারে অংশ নিক না কেন কাজ তাদেরই দিতে হবে। জানা গেছে, ওই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকলেও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের চাহিদা তৈরি করা হয়। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বরাদ্দ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তারাই এনে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এরপরেই শুরু হয় টেন্ডার কারসাজি। টেন্ডার ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয় টেন্ডার সিডিউল তৈরি করার সময়ই। সিন্ডিকেটের বিশেষ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ যাতে টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে সেভাবেই 'স্পেসিফিকেশন' তৈরি করা হয়। সিন্ডিকেটের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কেউ টেন্ডারে অংশ নিলেও সেগুলোকে নানা অজুহাতে 'নন-রেসপন্সিভ' করা হয়। এভাবেই কমমূল্যের যন্ত্রপাতি বেশি মূল্যে বা অস্বাভাবিক মূল্যে সরবরাহের কার্যাদেশ আদায় করে নেয় সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, তাতেও এরা ক্ষান্ত হয় না। এক দেশের তৈরিকৃত মালামাল সরবরাহের কথা বলে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আরেক দেশের তৈরি করা কম মূল্যের ও নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করে থাকে। দেখা যায়, ইউরোপ-আমেরিকার মালামালের কথা বলে চীন বা ভারতের মালামাল সরবরাহ করা হয়। যেহেতু সর্বত্রই সিন্ডিকেটের লোকজন নিয়োজিত থাকে তাই এসব জাল-জালিয়াতি কোথাও বাধা পায় না। আর এভাবেই হাতিয়ে নেয়া হয় সরকারের কোটি কোটি টাকা। মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে মিঠু সিন্ডিকেট আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর হঠাত্‌ অস্বাভাবিক উত্থান ঘটে স্বাস্থ্য খাতে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই। ২০১৬ সালে বিশ্ব তোলপাড় করা পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে যে ৩৪ বাংলাদেশির নাম উঠে এসেছিল, তাদের একজন এই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। দেশ থেকে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তাদেরই নাম ছিল ওই তালিকায়। তারপর কিছুদিন মিঠুর ব্যাপারে চলে তথ্যানুসন্ধান। সেসময় তার বিরুদ্ধে নন-সাবমিশন মামলা করেছিল দুদক। প্রাথমিক তদন্তের পর রহস্যজনক কারণে মামলার কার্যক্রম থেমে যায়! স্বাস্থ্যখাতের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকলেও মিঠু কখনোই সামনে আসেননি। বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। সূত্র জানায়, মন্ত্রী-সচিবসহ স্বাস্থ্যখাতের উপরের প্রশাসনিক পদগুলোতে যখন যিনি আসেন তিনিই মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। এছাড়া নিচের পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যখাতের শীর্ষ পদগুলোতে যারাই আসেন তারা কিছুদিন পর মিঠুর সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে যান। তাদের মাধ্যমেই স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকলেও চাহিদা তৈরি করা হয়। শুরু হয় টেন্ডার কারসাজি। মিঠুর প্রতিষ্ঠানের বাইরে কেউ টেন্ডারে অংশ নিতে পারে না, কিংবা নিলেও যাচাই পর্বে বাতিল হয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় আসল লুটপাট। নিম্নমানের মালামাল গছিয়ে দেওয়া হয় অস্বাভাবিক দামে। চীন বা ভারতের তৈরি মালামাল চালিয়ে দেওয়া হয় ইউরোপ-আমেরিকার মালামালের কথা বলে। গত দুই দশক ধরে এটাই হয়ে আসছে। সেসব অকেজো আর নিম্নমানের যন্ত্রপাতির 'ফল' ভোগ করছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। মিঠুর গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ইউনিয়নে। ২০১৬ সালে দুদক তার বিরুদ্ধে যে তদন্ত শুরু করেছিল, সেখানে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান হিসেবে। এর বাইরেও বেনামে রংপুরসহ দেশের আরো তিনটি হাসপাতালের মালিকানা রয়েছে মিঠুর কব্জায়। মিঠুর ঘনিষ্ঠ এক সূত্র জানায়, মিঠু বর্তমানে আমেরিকা ও সিঙ্গাপুর যাতায়াত করে সেখান থেকেই বাংলাদেশে তার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। তাঁর মূল প্রতিষ্ঠান লেক্সিকনের ঠিকানা পরিবর্তন করে গুলশানে নেওয়া হয়েছে। তাঁর এই অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও পরিবর্তন হয়েছে এর মধ্যেই। সেই সঙ্গে তাঁর পুরনো যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিয়ে অন্য নামে আরো কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন বলেও ওই প্রক্রিয়ায় যুক্ত একাধিক সূত্র জানিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের একাধিক সূত্র জানায়, মিঠুর একসময়ের 'ডান হাত' বলে পরিচিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মচারী ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ আয় ও সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্‌দ্ব শুরু হলে ফাঁস হয়ে যায় ওই দম্পতির প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিকানার বিষয়টি। দুদক ওই সূত্র ধরেই একে একে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তরের ৪৭ জনের বিরুদ্ধে তদন্তকাজ শুরু করে। পরে পর্যায়ক্রমে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা কার্যক্রম শুরু হয়। কয়েকজন গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ বদলি হন। এসব বিষয়ে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বক্তব্য নেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।