করোনায়ও আ'লীগের তৃণমূলে গৃহদাহ!

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

ফয়সাল খান
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণে সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করলেও থেমে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের বিরোধ। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় যেমন দলীয় নেতাকর্মীরা আহত-নিহত হচ্ছেন, তেমনি মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকেই। এতে একদিকে যেমন দলের জনপ্রিয়তা কমছে অন্যদিকে অভিমানে দূরে সরে যাচ্ছেন ত্যাগী, পরিশ্রমী ও পরীক্ষিত নেতারা। তাই অভ্যন্তরীণ এসব দ্বন্দ্ব নিরসনে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ চান তৃণমূল আওয়ামী লীগের কর্মীরা। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার নামে বিশৃঙ্খলাকারীদের চিহ্নিত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সূত্রমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। টানা ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূল আওয়ামী লীগে বিভিন্ন ধারার বলয় সৃষ্টি হয়েছে। তবে স্থানীয় এমপি ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা নেতাকর্মীরা অন্য বলয়ের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছে। তাদের দাপটে দলের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অনেক এমপি ত্যাগী নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে নিজের পছন্দের লোকজনকে দিয়ে মূল দল ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি দিতে চেষ্টা করছেন। এছাড়া নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম, বিলাসিতা, স্বজনপ্রীতির কারণে নিজ এলাকায় অধিকাংশ এমপির গ্রহণযোগ্যতা কমছে। একই সঙ্গে বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দল ক্ষমতায় থাকলেও বিনা কারণে মামলার আসামি হচ্ছেন অনেকেই। আর দলের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন হাইব্রিড ও দলছুট নেতাকর্মীরা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ ও দলটির সব সহযোগী সংগঠনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চলছে। তাদের এক পক্ষে নেতৃত্ব দিতেন সদ্যপ্রয়াত আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম এবং অন্য পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ডা. হাবিবে মিলস্নাত মুন্না। মোহাম্মদ নাসিম মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করেই প্রকশ্যে আসে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম স্মরণে গত ২৬ জুন দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে জেলা ছাত্রলীগ। এ সময় ওই সভায় যোগ দিতে আসেন জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও জামতৈল সরকারি হাজী কোরপ আলী ডিগ্রি কলেজ শাখার সভাপতি এনামুল হক বিজয়। দোয়া মাহফিলে যোগ দিতে যাওয়ার পথে শহরের বাজার স্টেশন এলাকায় তাকে মাথায় কুপিয়ে জখম করা হয়। এর ৯ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিজয়। মৃতু্যর পর গত মঙ্গলবার জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তার স্মরণসভায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে জেলা ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল হকসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, গত ৬ জুলাই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামিউল আলম সুমন ও একই এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা মামুন শেখ এলাকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। এতে স্থানীয় সান্দিয়ারা বাজারে দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় উভয় পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে বিলস্নাহ শেখ প্রতিপক্ষের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গত ২৪ মে তোরণ নির্মাণকে কেন্দ্র করে পটুয়াখালীর বাউফলে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের সঙ্গে বাউফল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়াউল হকের বিরোধ চলে আসছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে করণীয় বিষয়ে লেখাসংবলিত একটি তোরণ নির্মাণ করছিলেন মেয়র পক্ষের লোকজন। ওই তোরণ নির্মাণে বাধা দেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থকরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান মেয়র। তখন দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তারা। এতে তাপস নামের এক যুবলীগকর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় অন্তত ৯ জন আহত হন। ১৪ জুন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে পাবনার চাটমোহরে প্রতিপক্ষের অস্ত্রাঘাতে নিহত হন হাবিবুর রহমান হাবিব নামের এক ছাত্রলীগ নেতা। জানা গেছে, উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক  রাসেল আহম্মেদের গ্রম্নপের সঙ্গে  সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব ও তার সঙ্গীদের কথা কাটাকাটি হয়। পরে সন্ধ্যায় একদল যুবক হাবিব ও নাসিরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান হাবিব। এর আগে থেকেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছিল। যার নেতৃত্ব দিতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। গত  ৬ জুন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুলস্নায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক মোবারক হোসেন ও ফতুলস্না ইউনিয়ন ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক সমর্থিত দুই গ্রম্নপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সংঘর্ষে  আওয়ামী লীগের ৮ জন নেতাকর্মী আহত হন। গত ২৬ মে  নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমানউলস্নাপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্রম্নপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, দলীয় কোন্দল ও পূর্ব শক্রতার জেরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান মাহমুদ গ্রম্নপ ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা খোকন গ্রম্নপের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ৪ জন গুলিবিদ্ধসহ ১৩ জন আহত হন। গত ৩ মে জেলার সদর উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে জেলা যুবলীগের সহ-সম্পাদক বিলস্নাল মোলস্নার সঙ্গে একই এলাকার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাজু হাওলাদারের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। ওই দ্বন্দ্বের জের ধরেই দুই পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। এছাড়া প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে হামলা-সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটছে। এমন বেশিরভাগ ঘটনার পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারীরা জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এতে দিন দিন দুর্বল হচ্ছে তৃণমূল সংগঠন। কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও নানামুখী চাপের কারণে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না। কেননা সব সময়ই দলীয় সংসদ সদস্য ও তৃণমূল নেতাদের পেছনে কেন্দ্রীয় নেতাদের পৃষ্টপোষকতা থাকে। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম যায়যায়দিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। এই দলের নেতাকর্মীও অনেক। সবার মাঝে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিযোগিতার নামে কোনো বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না। এসব ঘটনার সাঙ্গে যারা জড়িত আছে, তাদের বিরুদ্ধে সংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।