কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবারও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা

টাস্কফোর্সের সভার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ধীরগতি সরকার চামড়া কিনবে এমন প্রস্তাব ঝুলে গেছে

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করছেন ব্যবসায়ীরা -ফাইল ছবি
গত বছর কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে নজিরবিহীন সংকট তৈরি হয়। দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় চামড়া রাস্তায় ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক চামড়া রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩০০-৪০০ টাকায় কিনেও সেই চামড়া ৫০ টাকা বিক্রি করতে পারেনি। করোনার কারণে চামড়া নিয়ে এবারও সেই সংকট আরও বাড়ার শঙ্কা করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী, কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি চামড়া শিল্প রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্স সভায় এসব শঙ্কার কথা জানান তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোরবানির পশুর চামড়ার সংকট উত্তরণ এবং চামড়া শিল্পকে রক্ষায় গত বছর অক্টোবরে সরকারের চারটি মন্ত্রণালয় ও বেশ কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। গত ফেব্রম্নয়ারিতে টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় এবারও কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা শঙ্কা করেন সরকারের খোদ তিনজন মন্ত্রী ও এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা। সভায় একগুচ্ছ প্রস্তাব ও কিছু সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে ছিল ঈদের এক মাস আগে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে ব্যাপকভাবে প্রচার, এক মাস আগে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারের চামড়া কেনার প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করা, প্রয়োজনে সরকার বাজার থেকে অবিক্রীত চামড়া কিনে গুদামজাত করা এবং কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা যায় কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু ঈদের বাকি আছে মাত্র ২০ দিন। কিন্তু সেই সভার একটি সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তার মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হলেও কবে নাগাদ সেই টাকা পাবেন বা কারা পাবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন ট্যানারি মালিকরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ডেপুটি সেক্রেটারি মিজানুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, গত বছরের চেয়ে আরও ভয়াবহ সংকট হবে। কারণ টাস্কফোর্সের সভায় সেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। সংকটের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই ট্যানারিগুলো সাভারে নিয়ে যাওয়া, মালিকদের জমির দলিল না দেওয়া, জমি ও কারখানার টাকা পরিশোধ করে মালিকদের নগদ টাকার সংকট, ব্যাংকগুলো ঋণ না দেওয়া, বিশ্বব্যাপী চামড়া দাম কমে যাওয়ার। তিনি বলেন, সাভারে যাওয়ার পরই ট্যানারি মালিকরা ঋণ খেলাপি হতে শুরু করেছে। এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। সভা সূত্রে জানা গেছে, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা যথাসময়ে চামড়া কিনতে অনাগ্রহী হয় তবে বাজারে অতিরিক্ত চামড়া সরকারিভাবে কিনে দুই-তিন মাস গুদামজাত করা হবে। এছাড়াও সারাদেশে মসজিদে ইমাম, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এতিমখানা ও মাদ্রাসার প্রধানদের চামড়া নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কেনাবেচা হয় কিনা তা মনিটরিং করতে জেলা প্রশাসক ও ইউএনদের সম্পূক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সরকারের দেওয়া ঋণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে সরকারের আর্থিক বিভাগ। এসব সিদ্ধান্ত কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তাও এখনো পরিষ্কার করতে পারেনি সরকার। সভায় চামড়া নিয়ে সার্বিক আলোচনা হলেও ৫টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর মধ্যে দেশের চামড়া শিল্পের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা, চামড়া শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিত করে তা উত্তরণের উপায়, চামড়া শিল্পের উন্নয়ন, বাজার সম্প্রসারণ ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ, দেশের পরিবেশ আইনবিধিমালা অনুসরণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কমপায়েন্স অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা এবং নতুন বাজার অনুসন্ধান, বিদ্যমান বাজারকে শক্তিশালী করে নতুন নতুন উদ্ভাবন, ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন। সভায় শিল্পমন্ত্রী নূরুল মাজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, চামড়া শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে তিনটি মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে কাজ করছে। গত বছরের মতো এবারও চামড়া সংকট যাতে তৈরি না হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি। চলতি বছর চামড়া যেন নষ্ট না হয় সেজন্য জেলাপর্যায়ে চামড়া সংগ্রহ করে বিভিন্ন গুদামে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, কাঁচা চামড়া সংগ্রহে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হবে। চামড়া শিল্পকে সম্প্রসারণের জন্য রাজশাহী ও চট্টগ্রামে শিল্পনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ীরা যাতে চামড়া কিনতে পারেন সেজন্য ট্যানারি মালিকদের সমন্বয়ে গত বছর দাম চামড়ার নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দামে ধস নামে। তিনি বলেন, ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের ফলে মালিকরা হাজারীবাগের জায়গা মর্টগেজ রেখে ব্যাংক লোন পাচ্ছেন না। যতদিন ট্যানারি মালিকদের আর্থিক সমস্যার সমাধান না হয়, ততদিন কোরবানির চামড়া নিয়ে একটি বিকল্প সমাধান বের করতে হবে। এক্ষেত্রে কোরবানির সময় সরকারকে চামড়া কিনতে হবে অথবা কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা যায় কিনা সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বাণিজ্য মন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। সে হিসেবে চামড়া শিল্পের আরও উন্নয়ন দরকার। কিন্তু বর্তমানে মানুষ কেন চামড়া কিনতে অনিচ্ছুক সে বিষয়টি খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেত্রেম্নটারি নুরুল ইসলাম বলেন, টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা বাস্তবায়ন হলে সংকট কাটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সাড়া মিলেনি। তিনি বলেন, ট্যানারি কারখানা সাভারে যাওয়ায় অনেক কারখানা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। এতে আশংকাজনকহারে কমে গেছে রপ্তানি। বিদেশী বায়ারদের চাহিদামতো চামড়া দিতে না পারায় তারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা বাংক ঋণের সুদ ৬ শতাংশ, ২০১৭ থেকে ১৯ পর্যন্ত সুদ মওফুকসহ আরও কয়েকটি দাবি জানিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপেরিটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ মঞ্জুরি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। ফিনিশড লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি দিলজাহান ভূঁইয়া জানান, এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এ খাতের ঋণখেলাপিদের নিয়ে একটি নীতিমালা করা দরকার। কোরবানির চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, তৃণমূলপর্যায়ে চামড়ার মূল্য নিশ্চিত করা, ওয়েট-বস্নু চামড়া রপ্তানি ও কোরবানির সময় বাণিজ্যিক ব্যাংক হতে চামড়া ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি সংশ্লিষ্টদের সাথে সভা করে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। শিল্প, বাণিজ্য, পরিবেশ মন্ত্রী ছাড়াও টাস্কফোর্সের সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান, পররাষ্ট্র. মৎস্য ও প্রাণী মন্ত্রণালয়ের সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ট্যানারি মালিক, লেদার খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, সারা বছর দেশে প্রায় ২ কোটি ৩১ লাখ গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয়। এর অর্ধেকই হয় কোরবানির ঈদে। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া মিলিয়ে দেশে কোরবানি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ পশু।