করোনা চিকিৎসায় প্রতারণা

নজরদারিতে আসছে হাসপাতালগুলো

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
দেশে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রতারণার নানা অভিযোগ ওঠার পর এখন স্বাস্থ্য বিভাগ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে আকস্মিক পরিদর্শন শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের পরিদর্শক দল গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় দুটি হাসপাতালে আকস্মিক পরিদর্শন করেছে এবং করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সব হাসপাতালে আকস্মিকভাবে যাবে তারা। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা প্রকাশ পাওয়ার প্রেক্ষাপটে কোভিড ১৯-এর চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে উঠেছে এবং মানুষের মাঝে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ চিকিৎসায় প্রতারণার অভিযোগে দুদিন আগে রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করে দেওয়া হয়। মামলা করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই জিকেজি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন জায়গায় বুথ বসিয়ে পরীক্ষার জাল রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা করার অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার ইসু্য নতুন করে সামনে এসেছে। ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলিয়ে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭১টি প্রতিষ্ঠানই যথাযথ মানসম্পন্ন নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেই মানসম্পন্ন নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাল এবং হলুদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা প্রকাশের প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ঢাকায় দুটি হাসপাতালে আকস্মিক পরিদর্শন করে তারা চিকিৎসার সন্তোষজনক পরিস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। তারা উলেস্নখ করেছেন, এখন করোনাভাইরাসের জন্য নির্ধারিত সব হাসপাতালে পরিদর্শক দল আকস্মিকভাবে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ড. আয়শা আকতার বলেন, হাসপাতালগুলোতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেল। কারণ আমরা যে বিশ্বাস করেছি, সেই বিশ্বাসটা ভেঙে ফেলছে যারা, এটাতো প্রতারণা। এটা অপরাধ। সেজন্য আমাদের নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।' স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেছেন, হাসপাতালগুলো মনিটর করার জন্য একটি কমিটি রয়েছে, সেই কমিটির তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। লাইসেন্সও নবায়ন নেই এদিকে, রোগী বেড়ে যাওয়ায় ২৯টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবকে করোনা পরীক্ষা ও সেবা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার। যাদের অধিকাংশেরই লাইসেন্স নবায়ন নেই। শুধু তাই নয়, করোনা রোগীর সেবা দেওয়ার পর্যাপ্ত আইসিইউসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নেই। এরপরও এসব হাসপাতাল, ক্লিনিককে দেওয়া হয়েছে ছোঁয়াচে এ রোগের চিকিৎসার অনুমতি। এতে সরকারি হাসপাতালের ভোগান্তি এড়াতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গেলেও সঠিক ফল ও চিকিৎসা নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভুগছেন রোগী ও স্বজনরা। উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা পরীক্ষায় ভয়াবহ জালিয়াতির পর অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানান, লাইসেন্স নবায়নের জন্য চাপ দিলেও বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক অনুমোদনের তোয়াক্কা করতে চায় না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নবায়ন না করেই রমরমা বাণিজ্য করছে কয়েক হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক। বছরের পর বছর লাইসেন্স না নিলেও অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর। লাইসেন্স নবায়ন না করে কীভাবে এসব হাসপাতাল চলছে তা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান যায়যায়দিনকে বলেন, এ ব্যাপারে তথ্য নিতে হলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে হবে। সারাদেশে কতগুলো হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া চলছে এবং এর সংখ্যা কত- সেই সংখ্যাও নিতে হলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। একই শাখার অন্য একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, 'লাইসেন্স না করে হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে অনলাইন পদ্ধতিতে আবেদন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে একটু সময় লাগছে। প্রতি বছর এটা ৩০ জুনের মধ্যে করা হয়, এবার সময় বাড়ানো হয়েছে। আগামী একমাসে অনুমোদন বা নবায়ন সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করে হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশা করছি আগামী ৩ মাসের মধ্যে সবাই অনুমোদনের আওতায় চলে আসবে।' রিজেন্টের পর লাইসেন্স নবায়নে প্রশ্ন ওঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওয়েবসাইটে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ডায়গনস্টিক সেন্টারে নিবন্ধন ও নবায়নের জন্য দরখাস্ত দেওয়ার পৃথক অপশনগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে নিবন্ধনভুক্ত হাসপাতাল-ক্লিনিকের তালিকা পর্যবেক্ষণে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সাইটটিও বন্ধ দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি বৈঠক করেছেন অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার কর্মকর্তারা। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে নিজেদের রক্ষা পথ খোঁজা বলেও ওই সূত্র জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের পর থেকেই বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন নবায়ন ঝুলে গেছে। ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এক পরিপত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন ফি ও নিবন্ধন নবায়ন ফি ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবায়ন ফি করা হয় আড়াই লাখ টাকা। অন্যদিকে, বিভাগীয় ও সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে থাকা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নবায়ন ফি ১০ থেকে ৫০ শয্যার জন্য ৫০ হাজার টাকা, ৫১ থেকে ১০০ শয্যার জন্য ১ লাখ, ১০০ থেকে ১৪৯ শয্যার ক্ষেত্রে দেড় লাখ, ১৫০ থেকে আড়াইশ শয্যার জন্য ২ লাখ টাকা করা হয়। একই শয্যাসংখ্যার জেলা পর্যায়ের হাসপাতালের জন্য যথাক্রমে ৪০ হাজার টাকা, ৭৫ হাজার, ১ লাখ ও দেড় লাখ এবং উপজেলা পর্যায়ের জন্য যথাক্রমে ২৫ হাজার, ৫০ হাজার, ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা করা হয়। এর পর থেকেই বেঁকে বসে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। জানা যায়, করোনা পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় নমুনা পরীক্ষাগার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে নিবন্ধন নবায়নবিহীন রিজেন্ট হাসপাতাল পরীক্ষা না করেই করোনার ফলাফল দিয়ে এবং অতিরিক্ত টাকা নিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। এর আগে লাইসেন্স না থাকা রাজধানীতে জবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ১৫ হাজার ৪৬০ জনের ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইভাবে কল্যাণপুরের বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে অর্থের বিনিময়ে করোনা পরীক্ষা করা হলেও চিকিৎসাকেন্দ্রটি চলতি বছরে নিবন্ধন নবায়ন করেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে করোনা পরীক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে ৭৫টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে বেসরকারিভাবে এভার কেয়ার হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, প্রভা হেলথ বাংলা?দেশ লি?মি?টেড, ইব?নে সিনা মেডি?কেল ক?লেজ হাসপাতাল, এনাম মে?ডি?কেল ক?লেজ হাসপাতাল, ইউনাই?টেড হাসপাতাল লি?মি?টেড, আনোয়ার খান মডার্ন মে?ডি?কেল ক?লেজ হাসপাতাল, বা?য়ো?মেডস ডায়াগ?ন?স্টিকস, ল্যাবএইড হাসপাতাল, ডিএমএফআর মলিকুলার ল?্যাব অ্যান্ড ডায়াগ?ন?স্টিক, ডিএনএ সলু্যশন লিমিটেড, সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, ডা. লাল প?্যাথ ল?্যাবস বাংলা?দেশ লিমিটেড, আই?সি হাসপাতাল, জয়নুল হক সিকদার ও?মেন্স মে?ডি?কেল ক?লেজ হাসপাতাল, এমএ?জেড হাসপাতাল লি?মি?টেড, দি ডিএনএ ল?্যাব, গুলশান ক্লি?নিক লিমিটেড, ইউ?নিভা?র্সেল মে?ডিকেল ক?লেজ ও হাসপাতাল, সিআরএল ডায়াগনস্টিকস, আহছা?নিয়া মিশন ক?্যান্সার অ্যান্ড ম?লিকুলার ডায়াগন?স্টিক ল্যা?বরে?ট?রি ছাড়াও চট্টগ্রামের ইমপেরিয়াল হাসপাতাল লিমিটেড, শেভরন ক্লি?নিক?্যাল প্রাইভেট লিমিটেড, বগুড়ার টিএমএসএস মেডি?কেল ক?লেজ ও রাফাতুলস্নাহ ক?মিউ?নি?টি হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জে গা?জী কো?ভিড-১৯ পি?সিআর ল?্যাব, গাজীপুরে ইন্টারন?্যাশনাল মেডিকেল ক?লেজ হাসপাতাল, ডা. ফরিদা হক মে?মো?রিয়াল ইব্রাহীম জেনারেল হাসপাতাল ও কোভিড-১৯ ডায়গন?স্টিক ল?্যাব করোনা পরীক্ষা করছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিবন্ধনের মেয়াদ উত্তীর্ণের অভিযোগ রয়েছে। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়নের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো তথ্য দিতে পারেননি। সূত্রে আরও জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় মোট ১৭ হাজার ২৪৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধন নিয়েছে। বিভাগ হিসাবে ঢাকায় ৫ হাজার ৪৩৬টি, চট্টগ্রামে ৩ হাজার ৩৭৫টি, রাজশাহীতে ২ হাজার ৩৮০টি, খুলনায় ২ হাজার ১৫০টি, রংপুরে ১ হাজার ২৩৬টি, বরিশালে ৯৫৭টি, ময়মনসিংহে ৮৭০টি এবং সিলেটে ৮৩৯টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। তবে এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অর্ধেকের বেশিই নিবন্ধন নবায়ন করা হয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের একজন নেতা যায়যায়দিনকে বলেন, প্রতি অর্থবছরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন নবায়ন করা বাধ্যতামূলক হলেও বছর দেড়েক আগে রাজধানীর মোহাম্মাদপুর এলাকায় লাইসেন্স ছাড়া পরিচালিত ১৪টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধে হাসপাতাল মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিল। যদিও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব প্রতিষ্ঠান ঠিকই চলছে। স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব যায়যায়দিনকে বলেন, মূলত চিকিৎসক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান (হাসপাতাল, ক্লিনিক, মেডিকেল কলেজ) সুরক্ষা আইন না থাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। এছাড়া লাইসেন্স ফি ও হাসপাতাল পরিচালনায় বিভিন্ন শর্তারোপ করায় অনেকে লাইসেন্স নবায়ন করতে চান না।