অনলাইন পশুর হাট

দামের তুলনায় গরু দেখে মন ভরছে না

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ডিজিটাল পশুর হাটের প্রচারে ব্যবহৃত ফেস্টুন ছবি সংগৃহীত
করোনাভাইরাস মহামারিতে অনলাইনে গরু কেনায় উৎসাহিত করা হলেও ক্রেতারা বলছেন, অনলাইনে গরুর দাম বেশি, এই দামে তাদের পোষাবে না। এছাড়া কোরবানির গরু সরাসরি কেনা বা এক সঙ্গে হাটে যাওয়ার যে আনন্দ তা এখানে না পাওয়ার বেদনাও পোড়াচ্ছে কাউকে কাউকে। হাট থেকে গরু কিনে রাস্তা দিয়ে দড়ি ধরে আসার সময় দরদাম জানতে চাওয়ার মজা থেকেও বঞ্চিত হতে রাজি নন কেউ কেউ। অনেকেই একটি গরু ভাগের হিসেবে কোরবানি দেন, তাই কয়েকজন মিলে পছন্দ করতে হাটে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দিলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কও রয়েছে ক্রেতাদের মাঝে। এদিকে অনলাইনে গরু কিনে কেউ ঠকবেন না বলে আশ্বস্ত করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছবি বা ভিডিওতে পশু দেখে বিচার করাটা এতদিনের অভ্যাস থেকে ভিন্ন বলেই দাম নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে এই সংকট কাজ করছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, কোরবানির সময় সারাদেশে যত পশু বিক্রি হয় তার প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগই বিক্রি হয় ঢাকায়। তাই বড় বড় শহরের ক্রেতাদের ধরাই তাদের মূল লক্ষ্য থাকে। ক্রেতা ধরতে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ই-কমার্স সাইটগুলো। এসব ওয়েবসাইটে দেওয়া বিভিন্ন পশুর দাম নিয়ে ফেসবুকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনলাইনে যে গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা, সেই গরু নিয়ে মো. আরিফুল নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, 'ভাই হাট থেকে এই গরু কিনতে ৩০ হাজার টাকা লাগবে। তাই আমি হাটে যামু।' হুমায়ুন কবির রাহাত বলেছেন, 'এই গরুর দাম ৭০ হাজার হয় কেমনে? আমাদের কি ছাগল পেয়েছেন? নাকি এক হালি গরুর দাম ৭০ হাজার?' মাহমুদ শাহরিয়ার নামে একজন লিখেছেন, 'এই দাম দিয়ে কেনার চেয়ে ১৫০০ টাকা দিয়ে পিপিই কিনে হাটে যাওয়া ভালো।' ফেসবুকে আরও নানাজনের প্রতিক্রিয়ায় গরুর বেশি দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তবে বেশি দামের অভিযোগ নাকচ করে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, 'দাম বেশি রাখার কোনো সুযোগ নেই, খুব কম লাভে ই-কমার্স সাইটগুলো গরু বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে।' সম্প্রতি যাত্রা শুরু করা 'ডিজিটাল হাট'-এ বর্তমানে আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পশু বিক্রি শুরু করলেও কয়েক দিনের মধ্যে ৫০টি প্রতিষ্ঠান বিক্রি শুরু করবে বলে জানান তিনি। ক্রেতাদের আশ্বস্ত করে তমাল বলেন, 'ই-কমার্স সদস্যদের মাধ্যমে পশু কিনলে ক্রেতারা নিশ্চয়তা পাচ্ছেন এবং পশুর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করেই বিক্রি করা হবে। এখানে প্রতারণার কোনো সুযোগ নেই।' করোনাভাইরাস মহামারিকালে কোরবানির পশু কেনাবেচার অনলাইন পস্নাটফর্ম 'ডিজিটাল হাট' গত শনিবার যাত্রা শুরু করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ই-ক্যাব ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে করা হয়েছে এই ডিজিটাল হাট। ডিজিটাল হাটে ক্রেতার প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি নেই দাবি করে ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে গরুর সর্বোচ্চ দাম ধরে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্রেতারা জ্যান্ত গরুর ক্ষেত্রে (লাইভ গরু) ৪০০ কেজির নিচে প্রতি কেজি ৩৭৫ টাকা, ৪০০ থেকে ৫০০ কেজির মধ্যে প্রতি কেজি ৪২৫ টাকা এবং ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি বা তার বেশি ওজনের গরুর জন্য ৪৭৫ টাকা কেজি দরে কিনবেন। এটা সর্বাচ্চ দাম, এর উপরে যাবে না।' এ হাট থেকে গরু কিনলে ঢাকা মহানগরের ভেতর গরুর ডেলিভারি চার্জ ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং খাসির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা। গরু বা খাসি অর্ডারের ক্ষেত্রে ১০% অগ্রিম পরিশোধ প্রযোজ্য, বাকি ৯০% পেমেন্ট ডেলিভারির সময় নেওয়া হবে। ক্যান্সেল করলে ১০% অগ্রিম পেমেন্ট ফেরতযোগ্য নয় বলেও জানান তমাল। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে খামারি ও ক্রেতাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য অনলাইন পস্নাটফর্ম 'ফুড ফর নেশন' নিয়ে এসেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। এই অনলাইন হাটের জন্য সারাদেশ থেকে গরু-ছাগলের চাষি, খামারি ও পশু ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যঃঃঢ়ং://ভড়ড়ফভড়ৎহধঃরড়হ.মড়া.নফ/য়ঁৎনধহর২০২০/ ওয়েবসাইটে গিয়ে বিনামূল্যে নিবন্ধন করার সুযোগ পাবেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাইটে গরুর ছবি দিয়েছেন অনেকে। এখানে ক্রেতারা বিক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলে দরদাম ঠিক করতে পারছেন। পাবনার আতাইকুলা ইউনিয়নের শরিফুল ইসলাম জানান, তিনি এ পর্যন্ত তিনটি গরু বিক্রির জন্য সরকারের ওয়েবসাইটে ছবি দিয়েছেন। তবে এখনও কোনো অর্ডার আসেনি। এবার স্থানীয় হাটেও কোনো সাড়া নেই। এলাকায় কোরবানিতে বিক্রির জন্য প্রায় ৫০ হাজার গরু রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'ঢাকায় গিয়ে গরু বিক্রি করতেও ভয় পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়ভাবে ডিজিটাল সেন্টারে অনেকেই গরুর ছবি নিয়ে বিক্রি করতে আসছে। সরাসরি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এই পস্নাটফর্মে স্বাচ্ছন্দ্যে গরু কিনতে পারেন ক্রেতারা।' এলাকা থেকে গরু বিক্রি হলে ঈদের দুই থেকে তিন দিন আগে কয়েকজনের গরু একসঙ্গে করে ট্রাকে শহরে নিয়ে ক্রেতার বাসায় পৌঁছে দেওয়া হবে বলে জানান শরিফুল ইসলাম। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, 'মহামারিকালে সংক্রমণ প্রতিরোধে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনলাইনে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে।' অনলাইনে বেশি দাম হাঁকার অভিযোগের বিষয়ে পলক বলেন, এখানে অভ্যাসটা তৈরি করতে হবে। ব্যবসায়ীদের বলা হয়েছে, তারা যেন অযৌক্তিক দাম না বলেন, তাহলে ক্রেতা পাবেন না। কারণ বিকল্প হিসেবে তাদের হাট রয়েছে। দেশের ১১ হাজার ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে পশু বিক্রেতারা বা খামারিদের অনলাইনে বিক্রিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, 'ফুড ফর নেশন পস্নাটফর্মটি কোরবানির পশুর জন্য দেশের সবচেয়ে বড় ম্যাচ মেকিং ডিজিটাল হাট হতে যাচ্ছে।' অনলাইন পশুর হাট নিয়ে অভিমত জানতে চাইলে পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমেদ বলেন, 'অনলাইনে গরুর দাম বেশি বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু হাজারীবাগে হাট বসবে তাই হাট থেকেই গরু কেনার ইচ্ছা তার।' ঢাকার বিভিন্ন এলাকার আগ্রহী ক্রেতারা জানান, হাটে গিয়ে কেনায় ভয় রয়েছে আবার অনলাইনে দাম বেশি-এ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। সিদ্ধান্ত নিতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে কোথা থেকে কিনবেন। তবে হাট থেকে কেনার যা আনন্দ সেই আনন্দ অনলাইনে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, গত বছর সারাদেশে এক কোটি ৫ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। ঢাকা বিভাগে ২৫ লাখ এবং শুধু ঢাকা মহানগরীতে ১৮ লাখ পশু কোরবানির জন্য বিক্রি হয়েছিল। সারাদেশে অ্যাসোসিয়েশনের ৮৪ হাজার সদস্য রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জেলা বা উপজেলায় যারা সংগঠনের নেতা রয়েছেন তাদের বলা হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে খামারি বা প্রান্তিক চাষিদের, যারা গরু বিক্রি করতে চায়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য করতে। কারণ সবার স্মার্টফোন নেই। সদস্যরা ঢাকায় গরু নিয়ে আসতে চাইলেও তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ ঢাকায় সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি। ঢাকার বাইরে অনেক বিক্রেতাই বলছে ঢাকায় নিয়ে গেলে কম বেশি যাই হোক হয়তো গরু বিক্রি হবে, তবে নিজে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হলে বেশি ক্ষতি হবে। সাদেক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান বলেন, 'ইন্টারনেটে গরু কিনে যেন কেউ প্রতারিত না হন, এজন্য উপজেলা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে চাষিদের সনদ সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে, অনলাইনে বিক্রি করার সময় ক্রেতাকে সেই সনদ সরবরাহ করলে সে নিশ্চিত হবে।' তিনি জানান, তার খামারে এবার দুই হাজার গরু প্রক্রিয়াজাত করে ক্রেতার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ৩৭৫ টাকা কেজি দরে (জীবন্ত গরুর ওজন) হিসাব করে বিক্রি করা হবে। ক্রেতা যদি প্রসেস করে নিতে চান তাহলে দামের ১৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিলে তা তার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হবে।