শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোর অনলাইন ব্যাংকিং ঝুঁকিতে অগ্রণী ব্যাংক

৩০ জুন বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পরিষদের বৈঠক হয় দায়ী কোম্পানিকে শোকজ ব্যাংক কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল
আহমেদ তোফায়েল
  ১৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার আপগ্রেড না করেই শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংকে। বিষয়টি উদঘাটিত হওয়ার পর দায়ী কোম্পানিকে শোকজ করেছে ব্যাংক। ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই কোম্পানির সঙ্গে সব চুক্তিও বাতিল করেছে। কিন্তু সফটওয়্যার আপডেট করতে নতুন কাউকে দায়িত্ব দিতে গড়িমসির কারণে অর্থনৈতিক ও কারিগরি ঝুঁকির মুখে পড়ে অগ্রণী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটির পরিচালনা পরিষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মতদ্বৈততার কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে জানান, অগ্রণী ব্যাংকে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার সরবরাহ ও আপডেট করার কথা সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেমিনস কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি ফ্লোরা টেলিকমের; কিন্তু ফ্লোরা টেলিকম ব্যাংকের এক কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল এবং ভুল তথ্য প্রদান করে একটি চিঠি তৈরি করে, যা ধরা পড়ার পর গোটা ব্যাংকিং খাতে টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যদিও ব্যাংকের জন্য কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারই হচ্ছে মূল বিষয়।

কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার : কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার হলো এমন একটি সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে ব্যাংকের মূল কাজগুলো করা হয়। যেমন- হিসাব ব্যবস্থাপনা, লেনদেন প্রভৃতি। আগে কাগজে লেনদেনের হিসাব রাখা হতো। ফলে গ্রাহক নির্দিষ্ট একটি শাখাতেই লেনদেন করতে পারতেন। এখন ব্যাংক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সব কার্যক্রম এই একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করা হলে ব্যাংকের শাখাগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। ফলে যে শাখাতেই অ্যাকাউন্ট খোলা হোক না কেন, দেশব্যাপী সেই ব্যাংকের যেকোনো শাখা থেকে নিয়মিত লেনদেনসহ অন্যান্য প্রায় সব ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়। ব্যাংকগুলোতে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার থাকার কারণে গ্রাহকরা রিয়েল টাইম ব্যাংকিং করার সুযোগ পাচ্ছেন। রাজধানীর কোনো ব্যাংকে টাকা জমা দিলে সঙ্গে সঙ্গে দেশের যেকোনো শাখা থেকে টাকা তুলতে পারেন গ্রাহক।

অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধার ব্যবহার বাড়াতে অগ্রণী ব্যাংক সফটওয়্যার কোম্পানি টেমিনস থেকে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ক্রয় করে। টেমিনসের স্থানীয় প্রতিনিধি ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের মাধ্যমে এ ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ১০ বছর মেয়াদে মোট ১৪ কোটি টাকায় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেড। চুক্তি অনুযায়ী প্রায় ১৫৫০ ব্যবহারিক লাইসেন্স দিয়ে অগ্রণী ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। পরে ২০১৪ সাল নাগাদ তা ৫১৫০ ব্যবহারিক লাইসেন্সে উন্নীত হয়; কিন্তু ফ্লোরা টেলিকম ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অগোচরে আনুপাতিক হারে হিসাব না করে সমুদয় লাইসেন্স ২০১৮ সালে নবায়ন করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ সময় মূল সফটওয়্যার কোম্পানি টেমিনসের কাছে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি গোপন রাখা হয়। একই সঙ্গে ফ্লোরা টেলিকম সফটওয়্যারের পুরানো ভার্সন (যা টেমিনস কর্তৃক সমর্থিত ছিল না) বলবৎ রাখে। অত্যাবশ্যকীয় সফটওয়্যার ভার্সন আপগ্রেডের বিষয়টি ব্যাংকের কাছেও গোপন রাখা হয়। যার জন্য অর্থনৈতিক ঝুঁকিসহ ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা ঝুঁকিতে পড়ে। এমনকি ফ্লোরা টেলিকম কাজটি করতে গিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের এক উপ-মহাব্যবস্থাপকের স্বাক্ষরও জাল করে। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর টেমিনস তাদের সেবা মার্চ, ২০২০ সাল থেকে বন্ধ করে দেয়। এ পরিস্থিতিতে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২০১৯ সালে আপগ্রেড ভার্সন দিতে সম্মতি জানিয়ে আর্থিক বাজেট দিলে তা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে। তবে পরিচালনা পরিষদ তা বাতিল করে দেয়।

পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পিপিআর-২০১৬ অনুযায়ী, ইজিপির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হলে সেখানেও অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে ১০০ কোটি টাকা বেশি ধার্য করায় দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। দরপত্র বাতিল হওয়ার পর ফ্লোরা টেলিকম অগ্রণী ব্যাংকের নামে জাল নোটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড তৈরি করে। এতে ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক শাহিনুর বেগমের স্বাক্ষর জাল করে, যা পরে টেমিনস বিষয়টি জানতে পেরে অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে যাচাই করে এবং সত্যতা নিশ্চিত হয়। তখনি অগ্রণী ব্যাংক ফ্লোরা টেলিকমকে শোকজ নোটিশ পাঠায়। ব্যাংক একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে। ব্যাংকের কেউ জড়িত আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টেমিনসের পক্ষ থেকেও ফ্লোরা টেলিকমকে পরিস্থিতি সমাধানের জন্য ২০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। তাতেও কোনো সুরাহা হয়নি।

এদিকে গত ৩০ জুন অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে টেমিনসের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আবার টেমিনস গত ২৬ জুন ২০২০ ফ্লোরা টেলিকমের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাতিল করে দেয়। এ অবস্থায় ১ জুলাই থেকে অগ্রণী ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেম ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

সূত্রমতে, গত ৩০ জুন বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্থানীয় প্রতিনিধি ফ্লোরা টেলিকমের সঙ্গে টেমিনসের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হওয়ায় এ সংক্রান্ত অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গেও ফ্লোরা টেলিকমের সম্পাদিত সব চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মেইনটেন্যান্স কোড এবং লাইসেন্সের মেয়াদ আরও এক মাস বৃদ্ধি এবং ওই সময়ে মেইনটেন্যান্স সার্ভিস তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্বকারী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অব্যাহত রাখতে টেমিনসকে চিঠি দিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সঙ্গে টেমিনসের স্থানীয় প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা সুবিধা অব্যাহত রাখতেও টেমিনসকে অনুরোধ জানানো হয়।

ব্যাংকটির একটি সূত্র জানায়, অত্যাবশ্যকীয় সফটওয়্যার ভার্সন আপগ্রেড করার কথা থাকলেও তা না করায় অর্থনৈতিক ঝুঁকিসহ নানা সেবা ঝুঁকিতে পড়ে অগ্রণী ব্যাংক। সফটওয়্যার ভার্সন আপগ্রেড করা লাগবে এমন তথ্য পরিচালনা পরিষদকেও জানানো হয়নি। ফলে গত ৩০ জুন অনুষ্ঠিত পরিচালনা পরিষদের বৈঠকে কোনো কোনো পরিচালক হতাশা ব্যক্ত করেন। আবার কেউ কেউ দায়ী কোম্পানির পক্ষাবলম্বনও করেন। নিয়ম অনুযায়ী বিষয়টি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্ব ছিল পরিচালনা পরিষদকে অবহিত করা; কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়।

সূত্রমতে, প্রদত্ত সহায়তা বা সেবা এক বছরের মধ্যে স্থগিত বা বন্ধ হয়ে যাবে এমন বিষয়টি ২০০৮ সালে সংস্করণটির পুনঃলাইসেন্সকরণের সময়ও পরিচালনা পরিষদের গোচরীভূত করা হয়নি। কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশে কারিগরি ঝুঁকিতে ফেলে দিয়ে ব্যাংকের প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অপকৌশলই ছিল এই লুকোচুরির মূল উদ্দেশ্য। সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি জানালেও তাদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে কোনো কোনো সূত্র।

তাদের মতে, দোষী কোম্পানি ভবিষ্যতে যাতে স্পর্শকাতর ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে ব্যবসা করতে না পারে সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ব্যাংকিং খাতে ফ্লোরা টেলিকমকে কালোতালিকাভুক্ত করা উচিত। এ ব্যাপারে ব্যাংকের আইনগত পরামর্শকরাও দোষী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করেছেন।

জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম রোববার যায়যায়দিনকে বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে টেমিনসের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মূল কোম্পানি টেমিনস গত ২৬ জুন ফ্লোরা টেলিকমের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাতিল করেছে। ফলে সফটওয়্যার আপডেট করতে নতুন যোগ্য ও দক্ষ প্রতিষ্ঠানকে খোঁজা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<106046 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1