কোরবানির পশু প্রসঙ্গে খামারিরা

লাভ চাই না, লসও যেন না হয়

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশের বিভিন্ন স্থানে জমতে শুরু করেছে কোরবানির পশুর হাট -যাযাদি
কোরবানির পশু হিসেবে গরুর চাহিদা থাকায় বেড়েছে গবাদি পশু পালন। কুষ্টিয়ার গ্রামাঞ্চলগুলোর প্রায় প্রতিটি পরিবারেই সন্তানের মতো করে লালন-পালন করা হয় গরু-ছাগল। ছোট কিংবা বড় পরিবার। গ্রামের কৃষক, ব্যবসায়ী কিংবা চাকরিজীবী। সবাই বাড়িতে একটি- দুটি করে গরু পালন করেন। কোরবানি উপলক্ষে প্রতি বছরই তারা এসব গরু বিক্রির জন্য মোটাতাজা করেন। ভালো দাম পাওয়ায় কষ্টের দিনগুলো ভুলে যান তারা। তবে করোনার কারণে গ্রামের এসব ক্ষুদ্র খামারি, প্রান্তিক চাষিদের আশঙ্কা লাভ তো দূরের কথা, এবারে গরু বিক্রি করতে পারবেন কিনা? কুষ্টিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, এ বছর কুষ্টিয়া জেলায় ৩৮ হাজারের বেশি গরু ও ছাগলের খামার রয়েছে। যেখানে খামারিরা কোরবানি উপলক্ষে গবাদি পশু পালন করেছেন। এসব খামারে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার গরু-মহিষ-বলদ এবং ৮০ হাজার ছাগল-ভেড়া কোরবারি উপলক্ষে পালন করা হয়েছে। এসব গবাদি পশুর আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা। বছরের সঞ্চয় বলতে পাঁচটি গরু, এক বছর ধরে লালন-পালন করে এখন হতাশায় ভুগছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের সদরপুর গ্রামের কৃষক আজিজুল ইসলাম। আজিজুল ইসলামের ছেলে সান্টু চাকরি করেন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। সেখান থেকে প্রতিমাসে টাকা পাঠান। কৃষিকাজ করে এবং ছেলের পাঠানো টাকা দিয়ে বাড়িতে গত বছর ছোট পরিসরে একটি খামার তৈরি করেন আজিজুল ইসলাম। তার খামারে রয়েছে চারটি দেশি জাতের এবং একটি শংকর জাতের ষাঁড়। কোরবানি উপলক্ষে তিনি এবং তার স্ত্রী মিলে গরুগুলোকে মোটাতাজা করেছেন। আজিজুল ইসলাম বলেন, গরু মোটাতাজা করা বেশ লাভজনক কাজ। গত বছর এই এলাকায় অনেকেই এ কাজ করে লাভবান হয়েছেন। তাই ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনটি গরু দিয়ে বাড়িতেই ছোট করে একটি খামার করেছি। লোন করে আরও দুটি গরু কিনেছি। এখন বর্তমানে গরু রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে চারটি দেশি এবং একটি বিদেশি। তিনি বলেন, গত কোরবানির ঈদের পরে পাঁচটি গরু কিনেছিলাম ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকায়। গরুগুলোকে নিজের সন্তানের মতো করে লালন-পালন করছি। বর্তমানে গো-খাদ্যের প্রচুর দাম। গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। প্রতিদিন পাঁচটি গরুর খাবারই লাগে দিনে ১৫০০-১৬০০ টাকার। তিনি বলেন, বর্তমানে এক একটি গরুর দাম হওয়ার কথা গড়ে এক লাখ থেকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা করে। এখনো কোনো ক্রেতাই আসেনি। বিগত দিনে দেখা গেছে কোরবানির ঈদের ১৫-২০ দিন আগেই গরু বিক্রি হয়ে যায়। তবে এবার করোনার কারণে নাকি গরুর ক্রেতা নেই। তাহলে এখন গরুগুলো নিয়ে কী করব। বিক্রি না করতে পারলে তো মহাবিপদে পড়ে যাব। একই এলাকার জলি খাতুন। তিনিও বাড়িতে পাঁচটি গরু এবারে কোরবানি ঈদে বিক্রির জন্য মোটাতাজা করেছেন। তিনিও শঙ্কায় রয়েছেন গরু বিক্রি নিয়ে। জলি খাতুন বলেন, নিজ হাতে গরুগুলোকে খাইয়ে বড় করছি। এই গরুগুলোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। ভালো দামে বিক্রি করার আশায় গরু মোটাতাজা করেছি। যখন গরু কিনেছিলাম তখন বাজার চড়া ছিল। ৭০-৭৫ হাজার টাকায় এক একটি গরু কেনা হয়েছিল। সাত-আট মাস ধরে পুষছি। এখন ক্রেতারা এসে ৮০ হাজার টাকা করে দাম দিতে চাচ্ছে। লাভ তো দূরের কথা এখন দেখছি সবই লস। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনি একটা গরুর পেছনে ৩০০-৩৫০ টাকার শুধু খাবারই দিতে হয়। এবারে করোনার কারণে গরুর দাম কম। ক্রেতা আসছে না। ঈদে গরু বিক্রি করতে পারব কিনা সেটাই এখন বড় চিন্তা। লাভ চাই না, লস না হলেই আমরা বাঁচতে পারব। ধার দেনা করে ছয়টি দেশি জাতের গরু মোটাতাজা করেছেন আলম সরদার। তিনি বলেন, ধানের খড় (বিচালী), খৈল, গমের ভুসি, খুদ, ছোলা, ভুট্টা, ডাল, ধান ভাঙানো কুড়া, ঘাস ইত্যাদি গরুকে খাইয়েছি। প্রতিটি খাবারের দাম এবার বেশি। শুধু নেই গরুর দাম। দেড় লাখ টাকার গরু ৮০ হাজার টাকা দাম বলছে। এক লাখের গরু ৬০ হাজার। আর গরু বিক্রি করতে না পারলে ধার দেনায় পথে বসে যাব। গত বছর দুটি গরু ভালো দামে ঢাকায় বিক্রি করেছিল ওই এলাকার সেলিম আহম্মেদ। এবারও তিনি দুটি গরু পালন করেছেন। তবে এ বছর তিনিও হতাশ। সেলিম আহম্মেদ জানান, গত বছর এক লাখ বিশ হাজারের গরু ২ লাখ টাকায় ঢাকায় বিক্রি করেছিলাম। এবার তো করোনার কারণে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারব কিনা সন্দেহ রয়েছে। আর গরু যেহেতু মোটা হয়ে গেছে। এখন আর খাওয়ালেও মোটা হবে না। কোরবানিতে বিক্রি করতে না পারলে খাওয়ানোই লস হবে। লাভ লস বুঝি না, এবার গরু বিক্রি করায় দায় হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখেই খামারিরা সারাবছর পশু হিসেবে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া লালন-পালনে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন। তাই ঈদে পশু বিক্রি করতে না পারলে বড় ধরনের লোকসান গুণতে হবে তাদের। কুষ্টিয়া থেকে গরু কিনে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া একাধিক মৌসুমি গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ঢাকায় হাটে যাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা। এ জন্য তারা এসব গরু কিনতে ভরসা পাচ্ছেন না। গরু ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম জানান, প্রতিবছর এক ট্রাক গরু এলাকা থেকে বিভিন্ন দামে কিনে ঢাকার কোরবানির পশু হাটে বিক্রি করি। এক মাস আগে থেকেই আমরা পশু কিনে থাকি। ঈদের ৭-১০ দিন আগেই গরুগুলো নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেই। তবে এবার করোনার কারণে এখনো গরু কিনিনি। অবস্থা দেখে ব্যবস্থা। যদি ঢাকায় হাটে যাওয়া না হয়, তাহলে গরু কিনে কি করব। মিরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সোহাগ রানা জানান, প্রতিবছরের মতো মিরপুর উপজেলার খামারিরা এবারও কোরবানির জন্য গরু মোটাতাজা করেছেন। সেই সঙ্গে ছাগল ও ভেড়া পালন করেছেন। করোনার কারণে কৃষক ও খামারিরা গবাদি পশুর অতিরিক্ত যত্ন নিয়েছেন। এবারে গবাদি পশুর রোগ-বলায় তুলনামূলক কম। আমরা করোনার মধ্যেও খামারিদের খোঁজখবর নিয়ে তাদের পরামর্শ ও পশুদের চিকিৎসা দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, কোরবানি উপলক্ষে যেসব পশু মোটাতাজা করা হয়েছে। সেসব পশু যদি বিক্রি করা না যায় তাহলে তাদের আর মাংস বৃদ্ধি হবে না। খাবার বেশি খাবে এতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর অনেক কৃষক পরিবার কোরবানি উপলক্ষে গবাদি পশু পালন করেছেন যদি তারা এসব পশু বিক্রি করতে না পারেন তাহলে আর্থিকভাবে ভেঙে পড়বেন। সেই সঙ্গে আগামীতে পশু উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হবে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, গত বছর কোরবানির পশুর দাম ভালো পাওয়ায় এ বছর কুষ্টিয়ায় পশু পালন বেড়েছে। কোরবানি উপলক্ষে গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একটি-দুটি করে গরু বা ছাগল পালন করা হয়েছে। জেলায় ১৫টি পশুর হাট রয়েছে। এসব হাট ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই পশু বিক্রি করা হবে। এ ছাড়া অনলাইনেও চলবে এই পশু বিক্রির কার্যক্রম। তবুও করোনার কারণে কিছুটা আশঙ্কা কৃষক ও খামারিদের মধ্যে থেকেই যায়। এদিকে পশু হাটের পাশাপাশি কোরবানির পশু বিক্রির জন্য অনলাইনে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কেনা-বেচার ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন জানান, এই করোনার সময়ে হাটে না গিয়ে ঘরে বসে গরু কিনতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনলাইনে কোরবানির পশুর হাট নামে একটি পেজ খোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় করা হবে। এদিকে কুষ্টিয়ার প্রায় ৩৮ হাজার খামারি, প্রান্তিক কৃষকের চিন্তা এখন কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে। তাদের দাবি সরকার যদি তাদের জন্য কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাদের পশু বিক্রির জন্য যদি কোনো কার্যকারী উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে তারা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বে।