ডিবি কার্যালয়ে মুখোমুখি আরিফ-সাবরিনা দম্পতি

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
আরিফুল হক চৌধুরী ডা. সাবরিনা চৌধুরী
করোনার নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেই চলেছেন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। এমনকি তিনি জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যানের পদেও কখনো ছিলেন না বলে দাবি করছেন। এ বিষয়ে তার সামনে অনেক দালিলিক প্রমাণ হাজির করা হলেও কৌশলে তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার প্রেশার দিলে তিনি কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে তাকে স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী এবং আরিফুলের ভগ্নিপতি সাঈদের মুখোমুখি করা হয়। তাদের জন্য একঝুড়ি প্রশ্নমালাও রেডি রয়েছে বলে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। এর আগে গতকাল তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুজনকেই ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। যদিও গতকাল সাবরিনার তিন দিনের রিমান্ড শেষ হয়। এ কারণে রিমান্ড শেষ হওয়ার আগে গতকাল রাতেই আরিফ ও সাঈদকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে আনা হয়। সাবরিনাকেও পুনরায় ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (তেজগাঁও) গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, 'সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রম্নত প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। তাদের এমন কর্মকান্ডের পেছনে অন্য কোনো যোগসূত্র আছে কি না- তাও খতিয়ে দেখা হবে।' তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে, মামলা ডিবিতে হস্তান্তরের পর আগের তদন্ত কর্মকর্তা তার কাছে থাকা সব ধরনের দালিলিক প্রমাণ ডিবিতে পৌঁছে দেন। সেখানে জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে সাবরিনা বিভিন্ন স্থানে যে পরিচয় দিয়েছেন তার অডিও ক্লিপও রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কাগজে তার স্বাক্ষরের বিষয়টিও হাজির করা হয়েছে। এরপরও জেকেজির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। বেশি প্রেশার দিলে তিনি কান্নাকাটি করছেন। আবার কখনো তিনি বিসিএস ক্যাডার বলেও হুংকার ছাড়ছেন। এমন পরিস্থিতিতে কৌশলী হয়েছেন তদন্ত তদারক কর্মকর্তারা। তারা সাবরিনার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী এবং আরিফুলের ভগ্নিপতি সাঈদকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার ভার্চুয়াল আদালতে আবেদনের পর বুধবার তাদের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। পরে তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনজনকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদের পর মুখোমুখি করা হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। তাড়াহুড়োর কারণ হিসাবে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, 'সাবরিনার তিন দিনের রিমান্ড শেষ হচ্ছে আজ (গতকাল)। এ কারণে রাতেই তাদের মুখোমুখি করা হয়। পরে সাবরিনাকে আবারও ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হবে।' ডিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, জিজ্ঞাসাবাদের আগে কিছু প্রশ্নমালা রেডি করা হয়েছে। সেখানে কার পরিকল্পনায় তারা এমন ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন, এর পেছনে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কারও যোগসূত্র রয়েছে কি না- তা জানার চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি কীভাবে তারা বাগিয়ে নিয়েছেন বড় বড় কাজ, কীভাবে অফিস কিংবা সর্বত্র ক্ষমতার দাপট দেখাতেন, জেকেজির লাইসেন্স না থাকার পরও কীভাবে বাগিয়ে নেন করোনা পরীক্ষার কাজ- এসব বিষয়ও রয়েছে ডিবির প্রশ্নমালায়। এছাড়া করোনা জালিয়াতির বাইরে আরও কোনো অপকর্মের সঙ্গে তারা জড়িত কি না- তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সূত্রমতে, স্মার্ট সাবরিনা আগে থেকেই যেন সবকিছুর উত্তর রেডি করে রেখেছেন। করোনা পরীক্ষা নিয়ে ভয়ংকর প্রতারণায় লিপ্ত প্রতিষ্ঠান জেকেজির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বরাবরই এড়িয়ে যাচ্ছেন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তেজগাঁও জোনের ডিসি হারুন অর রশীদ বলেন, 'আরিফ-সাবরিনা গংয়ের অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করে বর্তমান তদন্ত তদারক কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে তার সূত্রমতে, ছাত্রাবস্থাতেই উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন সাবরিনা। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে দেশের বাইরে থাকার কারণে পাশ্চাত্য জীবনযাপনেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজের ২২ ব্যাচের এই ছাত্রী বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মেতে উঠতেন ডিসকো আর মদের আড্ডায়। রাত-বিরাতে তাদের সঙ্গে ছুটে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়। ছাত্রাবস্থাতেই বিয়ে করে ফেলেন তারই এক ডাক্তারি পড়ুয়া সহপাঠীকে। তবে বেশি দিন টেকেনি তাদের বিয়ে। উচ্চাভিলাষী সাবরিনা পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেন এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে। তবে সেখানেও থিতু হতে পারেননি তিনি। আরিফ চৌধুরীর কারণে সেই সুখের সংসারেও কিছুদিনের মধ্যে বিষাদ ভর করে। ওই ব্যবসায়ীকে ডিভোর্স দিয়ে আরিফকে বিয়ে করেন সাবরিনা। সুন্দরী সাবরিনার ওপর ভর করে ওভাল গ্রম্নপের মাধ্যমে একে একে বাগিয়ে নেন আরিফ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বড় বড় ইভেন্টের কাজ। এসব কিছু এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও করোনা জালিয়াতি করার জন্য তারা জেকেজি নামের প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। এরপর বিভিন্ন বুথের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে নমুনা সংগ্রহ করে তা জালিয়াতি করতেন। পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, তারা বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছে। একটি ল্যাপটপ থেকে গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার ফ্লোর থেকে এই মনগড়া করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মেইলে পাঠায় তারা। তাদের কার্যালয় থেকে জব্দ ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। জানা গেছে, জেকেজির টেস্টে জনপ্রতি নেওয়া হতো সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি ১০০ ডলার। এ হিসাবে করোনার টেস্ট-বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এসব বিষয় সামনে আনার পরও সাবরিনা আরিফুলে উপর দোষ চাপিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। উলেস্নখ্য, জেকেজির ভুয়া করোনা টেস্টের মামলায় সাবরিনাসহ আরও সাতজন আসামি রয়েছেন। অন্যরা হলেন- সাবরিনার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী, আরিফুলের ভগ্নিপতি সাঈদ, কর্মকর্তা-কর্মচারী হুমায়ুন কবির, তানজিনা পাটোয়ারী, মামুন ও বিপস্নব। গত রোববার সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের তেজগাঁও ডিভিশনে আনা হলে পরে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সোমবার ঢাকার একটি আদালত সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।