পরিকল্পনা ছাড়াই চলছে দেশের স্বাস্থ্য খাত!

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদের ব্যাপারে তথ্য এবং নথিপত্র চেয়ে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং এনবিআরসহ নয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক। অন্যদিকে, নমুনা পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ারের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিবি পুলিশকে। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এসব অভিযোগ ওঠার পর স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। এখন আবার আলোচনায় এসেছে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতকে একেবারে ঢেলে সাজানোর বা সংস্কারের কথা বিভিন্ন সময় বলা হলেও এই খাত অস্থায়ী পরিকল্পনার ভিত্তিতে বা ইমার্জেন্সি ব্যবস্থাপনায় সব সময় চলছে। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পরপরই গত মার্চ মাসে সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সরবরাহ করা এন৯৫ মাস্ক এবং পিপিইসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রীর মান নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে আলোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই এখন প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজির বিরুদ্ধে। সংক্রমণ শুরুর আগের কয়েক মাসেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্বাভাবিক দামে পর্দা কেনাসহ বিভিন্ন হাসপাতালের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দুদক ১১টি মামলা করেছে। দুর্নীতির উৎস এবং সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রায় ছয় মাস আগে দুদক স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের কিছু সুপারিশও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছিল। দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, সংস্কারের প্রশ্নে কতটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- তা তারা এখনো জানতে পারেননি। তিনি বলেন, 'আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কিছু রিফর্ম করার জন্য বলেছিলাম। দুর্নীতির উৎস কী- সেগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। আমরা সেগুলো মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির ফাঁকফোকর বন্ধ করার জন্য সংস্কারের কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল। কতটুকু কী করেছে, আমরা একটা পর্যালোচনা করে দেখার চেষ্টা করছি।' দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'সংস্কারের সুপারিশে আমরা দুর্নীতির বিষয়টা এনেছি এবং দুর্নীতি কোথায় কোথায় হচ্ছে, সেগুলো আমরা দেখিয়েছি। কারণ আমরা মামলায় দেখেছি, শুধু বাক্স সাপস্নাই করা হয়েছে। মামলায় আমরা দেখেছি, ভেন্টিলেটর নেওয়া হয়েছে। ভেন্টিলেটরের অ্যাক্সেসরিজ কেনা হয় নাই। এগুলো তো অনিয়ম এবং দুর্নীতি।' বিশ্লেষকরা বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে কখনো সেভাবে সংস্কার হয়নি। যুগ যুগ ধরে এই খাত ঢাকা থেকে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়েছে। সে কারণে সিন্ডিকেটের দখলে দুর্নীতি হচ্ছে এবং চিকিৎসা সেবার বেহালদশা থাকছে বলে তারা মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলেন, স্বাস্থ্য খাত পরিচালনার পদ্ধতি পুরো ঢেলে সাজানোর জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বহুদিন ধরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে। অনেক সময় আমরা দেখেছি, সেই সিন্ডিকেটের শক্তি সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। কিন্তু সরকারের হাত কোনো সিন্ডিকেট বা কোনো গ্রম্নপের থেকে কখনো ছোট হতে পারে না। আমরা মনে করি, সরকারের হাত সিন্ডিকেটের চেয়ে বড় হবে।' অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলেন, 'স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর কেনাকাটা আছে। এই কেনাকাটা থেকে দুর্নীতিটা হচ্ছে। সেকারণে আমরা মনে করি, দক্ষ জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করা দরকার।' আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তিনিও মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতের মূল সমস্যা হচ্ছে পুরানো ধাঁচের ব্যবস্থাপনা। সেকারণে কোনো সংকট দেখা দিলে তাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু স্থায়ী কোনো পরিকল্পনা হয় না। অধ্যাপক রুহুল হক বলেন, 'স্বাস্থ্য বিভাগে এখন যে সংস্কার দরকার তা হলো আমূল পরিবর্তন। এটি করতে হলে আমাদের অনেকে মিলে বসে কী কী পরিবর্তন করা যায় তা আলোচনা করে ব্যবস্থাপনাটি করতে হবে। তা না হলে স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি বলেন, ডাক্তারদের অনুপস্থিতি বলেন বা হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থা সঠিক হচ্ছে না বলেন- এগুলো কখনোই ঠিক হবে না।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আপনারা জানেন, একেবারে সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট। একজন মন্ত্রী এবং একজন ডিজি সারাদেশের এত শত শত হাসপাতাল এক জায়গা থেকে কন্ট্রোল করেন। আমি মনে করি, বড় হাসপাতালগুলো এবং মেডিকেল কলেজকে ডিসেন্ট্রালাইজ করা দরকার। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করছে। সেরকম করতে হবে।' কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন তাতে তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সংস্কার করা হচ্ছে না কেন- এখানে সরকারের আন্তরিকতা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে কি না? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক রুহুল হক বলেন, 'আপনি যে কথা বলেছেন, আমরা কিন্তু এখন তাৎক্ষণিক বা অ্যাডহক ব্যবস্থা নিচ্ছি। যে সমস্যাটা হলো অর্থাৎ যেখানে চাকা লিক হয়ে গেলো, সেখানে একটু তালি দিচ্ছি। ইমার্জেন্সি ব্যবস্থাপনায় সকল সময়ে চলছে। ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য আমাদের একটি হেলথ কমিশন দরকার বলে আমি মনে করি।' কিন্তু অধ্যাপক হক নিজেই তো আওয়ামী লীগ সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি কেন তখন এসব সংস্কার করেননি? এই প্রশ্নের জবাবে তার বক্তব্য ছিল, 'আমি ডাক্তারদের প্রমোশনের পদ্ধতিসহ কিছু বিষয়ে সংস্কার করেছি। কিন্তু পুরো স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণ বা আমূল পরিবর্তন আনা অনেক বড় বিষয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই মিলে এই পরিবর্তন আনতে হবে। এটা অনেক আলোচনার বিষয়। আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সফল হইনি।' আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক রুহুল হক দাবি করেন, সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু তারপরও কেন সংস্কার করা যাচ্ছে না- সে প্রশ্নে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজির জালিয়াতিসহ দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে সবকিছু নিয়মনীতির মধ্যে চলছে। বিবিসি বাংলা