উত্তরাঞ্চলে বন্যার উন্নতি মধ্যাঞ্চলে অবনতি

প্রকাশ | ২৯ জুলাই ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বন্যার কারণে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। জামালপুরের মেলান্দহে মঙ্গলবার বিশুদ্ধ পানির সন্ধানে যাচ্ছে এক কিশোর -ফোকাস বাংলা
বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। তবে উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে প্রবেশ করায় সেখানে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে বানভাসি মানুষের। দেশে এ পর্যন্ত বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১৮টি জেলা। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর এবং নওগাঁ এই ৫টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। এসব জেলায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হতে পারে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও বন্যানিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরিয়তপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ ১৩ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। তবে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের ধরলা ও তিস্তা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাবে। এছাড়া গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে, ঢাকা জেলার আশপাশের নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি নদী সমতল স্টেশনের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৩টির, হ্রাস পেয়েছে ৫৫টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩টির। বিপৎসীমার উপরে স্টেশনের সংখ্যা ২৯টি এর মধ্যে ১৮টিতে অব্যাহত রয়েছে। সারাদেশে উলেস্নখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে জামালপুরে ৯১ মিমি, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭৫ মিমি, মহেশখোলায় ৭৩ মিমি, জারিয়ানঞ্জাইলে ৬০ মিমি, দিনাজপুরে ৫৫ মিমি এবং মৌলভীবাজার ৫২ মিলিমিটার। এদিকে ১৬ বছর পর বন্যার পানি ঢুকেছে রাজধানীতে। ডুবে গেছে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বেরাইদ, সাঁতারকুল, গোড়ান, বনশ্রী, বাসাবো, আফতাবনগরের নীচু এলাকা। রাজধানীর আশপাশের বালু, তুরাগ ও টঙ্গীখালের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞ এনামুল হক বলেন, পূর্বাঞ্চলে যতদিন বাঁধ নির্মাণ না হবে ততদিন বন্যায় ভাসতে হবে রাজধানীবাসীকে। ১০ দিন ধরে পানিবন্দি ঢাকার পূর্বাঞ্চলের মানুষ। পানি বাড়ছে প্রতিদিনই তার সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে দুর্ভোগ। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে ছোট ছোট বাঁধ, ভেসে গেছে মাছের ঘের। বালু নদীর পানি উপচে ঢুকে পড়েছে উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বেশ কয়েকটি এলাকায়। বেরাইদের ফকিরখালীর প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ঢুকেছে বানের পানি। সুপেয় পানির সংকটে এ অঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার। এলাকাবাসীরা জানান, রাজধানীতে আমরা ৯৮ এর পর এত পানি দেখিনি। ডেমড়া থেকে টঙ্গী বেড়িবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে আমাদের কষ্ট লাঘব হচ্ছে না। স্থায়ীবাসিন্দারা বলেন, রাতে যখন ঘুমিয়ে থাকি মাঝ রাতে বিছানায় পানিতে ভিজে যায়। তখন বিছানার উপরে উঠে বসে থাকতে হয়। ৯৮ সালে যে রকম বন্যা দেখেছি, ঠিক তেমনি ২০২০ সালে এসে এই রকম বন্যা দেখছি। ৮৮ সালের বন্যার পর রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলেও পূর্বাঞ্চল এখনও অরক্ষিত। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে জলাভূমি ভরাট করে। ফলে নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলেই ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। নদী বিশেষজ্ঞ ম. এনামুল হক বলেন, বালু নদীর পাড় দিয়ে বন্যা প্রতিরোধের একটা বাঁধ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প কয়েক যুগ ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই বন্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে পূর্বাঞ্চলে বাঁধ দিতেই হবে। রাজধানীর গোড়ান, বনশ্রী, বাসাবো, আফতাবনগর, সাঁতারকুলের নীচু এলাকায়ও ঢুকেছে বন্যার পানি। এ ছাড়া ডেমরা, যাত্রাবাড়ী ও ডিএনডি বাঁধ এলাকাতেও বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে। আমাদের সিংগাইর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম ইউনিয়নের বড়াটিয়া বাজারসহ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে আশপাশের বেশ কিছু বসতবাড়ি। এ ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা  পেলেও সরকারিভাবে জোটেনি কোনো সাহায্য। এছাড়া ভাঙন রোধেও নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ঘর-বাড়ি হারিয়ে অনেকেই এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। সরেজমিন মঙ্গলবার ( ২৮ জুলাই ) ভাঙন কবলিত এলাকায় দেখা গেছে বড়াটিয়া বাজারের পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব-দক্ষিণে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব?্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে ওই বাজারের ৩০টি ব?্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ২০-২৫টি বাড়ি সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বসত বাড়ি হারিয়ে আব্দুল খালেক, মোশাররফ হোসেন, আরিফ হোসেন, আব্দুল হালিম মিয়া ও আব্দুল ছালাম পরিবারের সবাইকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অপরদিকে, ওই বাজারের ব?্যবসায়ী মোঃ শাহজাহান, ইদ্রিস মিয়া, বিলস্নাল হোসেন, রাসেল হোসেন, কুদ্দুস মিয়া, মফজেল হোসেন ও নূরুল আমিন ব?্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বতর্মানে তারা পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছেন। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে সিংগাইর-বালুখন্ড পাকা সড়কটিও। এছাড়া উপজেলার চান্দহর ইউনিয়নের বার্তাগ্রাম প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, এলাকাবাসীর আপ্রাণ প্রচেষ্টাতেও রক্ষা হলো না গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বালুয়া গ্রামের বাঙালী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এর ফলে পার্শ্ববর্তী বোঁচাদহ এলাকায় একদিন আগে একইভাবে ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকে পড়ছে মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নসহ পাঁচটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকায়। আসন্ন ঈদের পূর্বমূহুর্তে বাঁধটির ভেঙ্গে যাওয়া অংশ দুটি নতুন করে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে মহিমাগঞ্জ বাজারসহ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষকে। এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, এ দুটি পয়েন্টে কয়েকবার ভাংগনের পর এলাকার লোকজনের আবেদনের প্রেক্ষিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঙালী নদীর এ বাঁধটি মেরামত শুরু করে। গত দুই বছর ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামান্য কিছু কাজ করে রহস্যজনক কারণে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। এ কারণেই কাজটি আর শেষ না হওয়ায় গত সোমবার সন্ধ্যায় বাঙ্গালী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের বালুয়া পয়েন্টে ভেঙ্গে প্রবল বেগে পানি ঢুকতে শুরু করে। একই ভাবে আগের দিন একই বাঁধের দুই কিলোমিটার ভাটির বোচাদহ এলাকায় ভেঙ্গে যায়। এর ফলে মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের পুনতাইড়, বালুয়া, শিংজানী, আমবাড়ী, বোচাদহ, ছয়ঘরিয়া, শ্রীপতিপুর, রাখালবুরুজ ইউনিয়নের হরিনাথপুর, বিশপুকুর, কাজীপাড়া, শিবপুর ইউনিয়নের শিবপুর, কোচাশহর ইউনিয়নের শাহপুর, কানাইপাড়া, বুড়াবুড়ি, শালমারা ইউনিয়নের উলিপুর, দামগাছা, শাখাহাতি বালুয়া, শালমারা, কলাকাটা, বাইগুনিসহ বেশ কটি গ্রামের অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে প্রবেশ করেছে বন্যার পানি। এতে সম্পূর্ণভাবে পস্নাবিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় নদী রক্ষা বাঁধ, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, কালভার্ট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কাঁচা-পাকা রাস্তাসহ ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বন্যার কারণে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় বিষধর সাপের দংশনে ২ জন এবং পানিতে ডুবে ১ জনের মৃতু্য হয়েছে। উপজেলার ধলেশ্বরী নদীর এলাসিন পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৬৩ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সে কারণে উপজেলায় নতুন নতুন গ্রাম বন্যায় পস্নাবিত হয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দিন দিন বেড়েই চলছে। বন্যার কারণে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যাদুর্গত অঞ্চলের মানুষ। চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে দিন পাড় করছেন তারা। করোনা ভাইরাস ও বন্যাকবলিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পড়েছে সীমাহীন কষ্টে। তাদের ক্ষতি যেন পূরণ হওয়ার নয়। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরবর্তী এলাকার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়িসহ সরকারি কাঁচা ও পাকা রাস্তা। এতে চরম কষ্টে দিন কাটছে বন্যাদুর্গত মানুষের। লাখাই (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গত কয়দিনের বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে হাওড়বেষ্টিত জনপদ হবিগঞ্জের লাখাই। ইতোমধ্যে উপজেলার নিম্নাঞ্চলসহ প্রতিটি এলাকার মানুষকেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পানির জন্য। নৌকা, বাঁশের সাঁকো আর ভেলার নির্ভরতা বেড়েছে পাড়া মহলস্নাগুলোতে। বিশেষ করে উপজেলার লাখাই সদর ইউনিয়নসহ শিবপুর, সুজনপুর, রুহিনসী, আমানুলস্নাহ পুর, মামুদপুর, চিকনপুর, কৃষনপুর, গদাইনগর,কামালপুর, লালচানপুর, ও সিতারামপুরসহ বুলস্না ইউনিয়নের মাদনা বেগুনাই, কাটাইয়া, ফরিদপুর, মকসুদপুর, মীরপুর, বলাকান্দি, গোয়াকারা, চরগাও, হেলারকান্দি, করাব ইউনিয়নের গুনীপুর, আগাপুর,হরিনাকুনাসহ কিছু এলাকা, সাতাউক, তেঘরিয়াসহ বেশ কিছু এলাকার মানুষ পানিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে।